ডিপসিক এআই
মো. ফজলুল করিম পাটোয়ারী
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:২৫ এএম
মো. ফজলুল করিম পাটোয়ারী
সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে বড় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডিপসিক। এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটি ব্যয়ের দিকে অন্য এআই অ্যাসিস্ট্যান্টকে অল্প কদিনেই ছাপিয়ে গেছে। কোন অ্যাপ কতটা জনপ্রিয় তার প্রাথমিক প্যারামিটার অনলাইন অ্যাপস্টোর বা প্লেস্টোর থেকে কবার ডাউনলোড করা হয়েছে। ডিপসিক চলতি বছর ১০ জানুয়ারি প্রথম উন্মুক্ত করা হয়। উন্মুক্ত করার পর থেকে অ্যাপটি এখন পর্যন্ত ২৬ লাখ বার ডাউনলোড করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের এ নতুন এআই মডেলের উত্থান এআই খাতের বর্তমান নেতাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এর ফলে প্রযুক্তি খাতে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ডিপসিকের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি খাতের শেয়ারবাজারে বড় ধস নেমেছে। এ পরিস্থিতিতে এনভিডিয়ার বাজারমূল্য থেকে প্রায় ৫৯৩ বিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে গেছে, যা ওয়াল স্ট্রিটের ইতিহাসে কোনো কোম্পানির জন্য এক দিনে সর্বোচ্চ ক্ষতির রেকর্ড। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা স্টার্টআপ ডিপসিকের নতুন কম খরচের এআই অ্যাসিস্ট্যান্টের জনপ্রিয়তা এবং এর প্রভাব প্রযুক্তি খাতে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বেড়েছে, যা ন্যাসডাক সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিপসিকের সবচেয়ে বড় চমকপ্রদ বিষয়, সিলিকন ভ্যালির তাবত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ীভাবে তারা এ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল তৈরি করেছে।
ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও এ ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। বৈশ্বিক প্রযুক্তির দৌড়ে মূল প্রতিযোগিতা চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। এতদিন এআইশিল্পের বড় সব উদ্ভাবন এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রকে এআইশিল্পের নেতাও গণ্য করা হতো, এখন সে অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ করল ডিপসিক। চ্যাটবটটি পরিচালিত হয় ডিপসিক-ভি৩ মডেল দ্বারা; যেটি একটি ওপেন সোর্স মডেল। এটি তৈরিতে মাত্র ৬০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন এর উদ্ভাবকরা। অথচ বাজারে তাদের অন্য প্রতিযোগীরা এআই তৈরিতে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছেন। ডিপসিক একটি গবেষণাপত্রে দাবি করেছে, তারা ২ হাজার এনভিডিয়া এইচ৮০০ জিপিইউ ব্যবহার করেছে, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একটি কম উন্নত চিপ ও ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে আর১ বেস মডেল ভি৩ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইইউ) স্যাম অল্টম্যান বলেছেন, তাদের জিপিটি-৪ মডেল প্রশিক্ষণ করতে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়েছে, যেখানে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, তারা আরও ২৫ হাজার উন্নত এইচ১০০ জিপিইউ ব্যবহার করেছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ডিপসিকের অবকাঠামোর জন্য মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি এত অল্প অর্থে করা সম্ভব নয়। ফলে ডিপসিক নিয়ে যে উন্মাদনা ছিল তা কমতে শুরু করে। আস্তে আস্তে ওপেনএআই এবং অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শেয়ারবাজারে দর বাড়তে শুরু করে। অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে আরেকটি নতুন মডেল এসেছে, যা দেখিয়ে দিয়েছে অনেক অল্প খরচেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গড়া যায়।
কিন্তু আমার মতে, এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডেভেলপের মূল আকর্ষণ কীভাবে একটি স্টার্টআপ ক্রমেই চীনের আইকনিক উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। ডিপসিক একটি স্টার্টআপ। অর্থাৎ তারা নিজস্ব অর্থায়নে এর কাজ শুরু করে। কিন্তু এর সফলতা ভূরাজনৈতিক মাত্রা পায় যা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রযুক্তিযুদ্ধের দিকটি ইঙ্গিত করে। ফলে আইটি খাতের ভূরাজনৈতিক প্রভাবকটি আমাদের বিবেচনা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণী ওয়েনফেং প্রথম এ স্টার্টআপ শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সরকারি অর্থায়ন পান। কাজের একপর্যায়ে যখন তার মনে হলো, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এখন এটির কোম্পানি তৈরি করা যায় তখন ২০২৩ সালে তিনি অংকটি নামে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এ হলো ডিপসিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্মলগ্ন। কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর মূল প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। বারবার পরীক্ষানিরিক্ষা এবং বেশ কয়েকবার এর ব্যবহারযোগ্যতা নিশ্চিত করার পর অবশেষে ১০ জানুয়ারি সর্বসাধারনের ব্যবহারের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেন। তার পরই গোটা বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। যদিও চ্যাটজিপিটির মতো এতটাও দ্রুতগতির নয় এবং এখনও ডিপসিকের সার্ভার প্রচুর তথ্য সংগ্রহে ধীরগতির; কিন্তু একটি স্টার্টআপ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বৈশ্বিক পর্যায়ে উঠে আসার বিষয়টি অনুপ্রেরণার।
ডিপসিকের ডেভেলপার ও প্রতিষ্ঠাতার দাবি, তারা নানা সুবিধা ও এসব সুবিধা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করলে আগামী দিনে অন্যতম জনপ্রিয় এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে উঠবেন। শুধু তাই নয়, এর ব্যবহার যত বাড়বে ততই মুনাফা আসতে শুরু করবে এবং চীন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। কোম্পানিটি শীর্ষ চীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তরুণ এআই গবেষক নিয়োগ করেছে এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান ক্ষেত্রের বাইরে থেকেও নিয়োগ করেছে, যাতে মডেলের জ্ঞান ও ক্ষমতা বৈচিত্র্যময় হয়। অর্থাৎ কর্মসংস্থান তৈরি এবং প্রযুক্তি বাদেও কলাবিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান এবং অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রে অধ্যয়নকারীদেরও যুক্ত করে ডিপসিককে আরও কার্যকর করার ভাবনা রয়েছে। যেমনটি বলেছি, ডিপসিক একটি এআই চ্যাটবট তৈরি করেছে এবং এটি চ্যাটজিপিটির মতোই কাজ করে। তবে ডিপসিকের বিশেষত্ব হলো এটি ওপেন সোর্স অর্থাৎ এর কোড ব্যবহার, সংশোধন এবং দেখার জন্য সবার জন্য উন্মুক্ত। এটি নির্মাণের উদ্দেশ্যে সোর্স কোড এবং ডিজাইন ডকুমেন্টস অ্যাকসেস এবং ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
ডিপসিকের সাফল্য দেখে আমাদের আইটি খাত নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ডিপসিক সাফল্য পাওয়ার পর হাজারো স্টার্টআপ হারিয়ে গেছে। তারা আর বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। আমাদের দেশে সম্প্রতি ফ্রিল্যান্সাররা আইটি প্রতিষ্ঠানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক নানা প্রজেক্ট এবং মার্কেটপ্লেসে এআই পণ্য তৈরি করে আয় করছেন। কিন্তু কোনো স্টার্টআপ শুরুর বিষয়ে তারা উদ্যোগ নিতে পারে না। কারণ, এজন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই। থাকলেও তা কীভাবে পাওয়া যায় তার সুস্পষ্ট নীতিমালা ও বিবরণ নেই। আমাদের আইটি খাতে নীতিমালার অভাব থাকায় অসংখ্য অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে এবং সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও উপযুক্ত স্টার্টআপ বিনিয়োগ পাচ্ছে না। চীনে ডিপসিকের সাফল্যে চীনেরই বিনিয়োগ করা সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে যেহেতু অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ডিপসিকের সাফল্য তাদের লাখ লাখ মিলিয়ন ডলার আয়ের পথ উন্মুক্ত করেছে, যা তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য পর্যাপ্ত। ফলে আইটি খাত যে অনেকাংশে অস্থিতিশীল তা বুঝতে হবে। আমাদের দেশে আইটি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিকোণের অভাব রয়েছে।
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তিবিষয়ক অনেক সাবজেক্ট রয়েছে। কম্পিউটার সায়েন্স, রোবোটিকস, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এমনকি এআই ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাডিজও রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী প্রযুক্তিতে মেধার স্বাক্ষর রাখার স্বপ্ন দেখে। সীমাবদ্ধতার পরও তারা বৈশ্বিক অনেক অলিম্পিয়াড ও প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করলে তা পত্রিকার শিরোনাম হয়। এ শিক্ষার্থীর অনেকে ভাবেন তাদের মডেলটি আরও উন্নত করতে। কিন্তু দেশের সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায় না বলে তারা অনুৎসাহিত হন। অনেকে বিদেশ পাড়ি জমান এবং তাতে ওই দেশই লাভবান হয়। অথচ আইটি খাতের যে আর্থিক সম্ভাবনা আছে তার জন্য বিনিয়োগ করা জরুরি। বিগত বছরগুলোয় আমরা অবকাঠামোয় প্রচুর বিনিয়োগ করেছি। প্রযুক্তিতে বিগত সরকার যে বিনিয়োগ করেছে তার অধিকাংশই অপচয় হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রেই যেন শুধু প্রেস্টিজ উদ্যোগ। বাস্তবে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে। অথচ দেশে দক্ষ ফ্রিল্যান্সার, প্রোগ্রামার রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ক্ষেত্রে গবেষণা চালানোর সুযোগ আছে। কিন্তু এসবের সদ্ব্যবহার হচ্ছে না।
আমরা দেখছি, দেশে অনেকে ব্যবসার নামে লাখ টাকা লোন নিয়ে খেলাপি হচ্ছে। সরকার অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে লোন রিশিডিউল করে মওকুফ করছে। অন্যদিকে স্টার্টআপ খাতের জন্য ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা নেই যদি না তারা রাজনৈতিক অনুগ্রহ পায়। দেশের প্রযুক্তি অধ্যয়নে থাকা শিক্ষার্থীরা আগ্রহ থেকেই চেষ্টা করবে ভালো কিছু করার। তরুণ প্রজন্মের প্রতি এ আস্থা রয়েছে। অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা কিংবা সুযোগের জন্য বিদেশে যাওয়ার বদলে দেশেই যখন তারা সুবিধা পাবে তখন তারা বাংলাদেশেই উন্নত প্রযুক্তি তৈরি করবে। এসব প্রযুক্তি আমাদের বৈশ্বিক বাজারে গর্ব করার সুযোগ করে দেবে। বৈদেশিক মুদ্রা আসবে এবং প্রযুক্তি খাতে অন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক কমে আসবে। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে এসব উদ্যোগ নিলেও তাদের সীমাবদ্ধতা থাকে। আমাদের দেশে সরকার এ বিষয়ে যেহেতু উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যের কথা বলে, তাই তাদের উচিত স্টার্টআপগুলোতে উৎসাহ বাড়ানো এবং এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া। বিনিয়োগের সুষম বণ্টন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রকল্প আকারে চালু করাসহ নানা কার্যক্রম নেওয়া সম্ভব। এজন্য চাই পরিকল্পনা ও সুদূরপ্রসারী বাস্তবিক লক্ষ্যমাত্রা। তরুণ প্রজন্মের উৎসাহ ও মেধা কাজে লাগাতে হবে। না হলে প্রযুক্তি খাতে পিছিয়ে যাব আমরা। আর তাতে ক্ষতি আমাদেরই।