ইকরামউজ্জমান
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:১৭ এএম
ইকরামউজ্জমান
স্বাধীনতার পর শূন্য থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে পুণ্য করার কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আশা নিয়ে। যারা এখন বলছেন, এর শেষ হয়েছে অন্ধকার আর হতাশা দিয়ে; এটি মেনে নিতে পারছি না। এজন্য যে, ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের বেশ কিছু অর্জন আছে। আছে অভিজ্ঞতাও। ক্রীড়াঙ্গনের অর্জন শুধু ব্যক্তি বা সমষ্টির দৃষ্টিতে দেখলে হবে না; এটি বিবেচিত হতে হবে রাষ্ট্রীয় ‘পারসপেকটিভে’। একটি বিষয়ে সচেতন জনগোষ্ঠী একমত, ক্রীড়াঙ্গন যদি আদর্শ, মূল্যবোধ আর স্বাধীনতার চেতনায় পরিচালিত হতো, পরিচালিত হতো ন্যায়ভিত্তিক এবং বৈষম্যহীনভাবে, গণতান্ত্রিক চর্চা ধ্বংস না করা হতো, ক্রীড়াঙ্গনে যদি জবাবদিহি, দায় স্বীকার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে গত ৫৩ বছরে বিভিন্ন খেলা থেকে অর্জন আরও বেশি হতো।
প্রথম থেকেই ক্রীড়াঙ্গনে বেশ কিছু মৌলিক দিক নিয়ে ভাবা হয়নি। ভাবা হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দুয়েকটি খেলা ছাড়া আমাদের অবস্থান বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই। এটি বাস্তবতা।
বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশটি বিরাট জনসম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত অলিম্পিক থেকে পদক জয় দূরের কথা, ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর হলেও গা সওয়া হয়ে গেছে। বিগত দিনগুলোতে যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল সে সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে ক্রীড়াঙ্গনসংশ্লিষ্ট মহলের সবাই বছরের পর বছর ধরে অনেক আশ্বাসের কথা শুনিয়েছেন। এ সবই ছিল সময় পার করার জন্য। গত ৫৩ বছরেও ক্রীড়াঙ্গন-উপযোগী ‘ক্রীড়ানীতি’ প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। ভাবা যায়! বারবার বলা হয়েছে, ক্রীড়ানীতি প্রণয়নের জন্য সময় দরকার। বারবার সময় চাওয়া হয়েছে। চাইলে কিন্তু এত বছরে ক্রীড়ানীতি প্রণয়ন করা যেত। এমনিতে তো আর ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি মানুষের গভীর সম্পৃক্ততা এবং উৎসাহ কমেনি। মানুষ দেখেছে বছরের পর বছর ধরে কীভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি থেকেছে ক্রীড়াঙ্গন। মানুষ দেখেছে কীভাবে বিভাজন সৃষ্টি করে একাত্মবাদিতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিছু অযোগ্য মানুষের জন্য ক্রীড়াঙ্গন উল্টোপথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে।
সেই প্রথম থেকেই দেশের ক্রীড়াঙ্গন এবং খেলাধুলার চর্চার ক্ষেত্রে ‘সিভিল সোসাইটি’র আগ্রহ এবং উৎসাহ কম। অথচ তাদের ভূমিকা, পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ‘গাইডেন্স’ হতে পারত আস্থা এবং আত্মবিশ্বাসের। ক্রীড়া সাংবাদিকরা তো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ভূমিকা পালন করতে পারবেন না। তাদের সে সুযোগও নেই।
বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন ক্রীড়াঙ্গন গঠনের চ্যালেঞ্জ এবং সেখানে গণমানুষের প্রত্যাশা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা, সীমাবদ্ধতা, দ্বন্দ্ব-পরবর্তীতে আমরা কী দেখেছি! ক্রীড়াঙ্গনের মূল্যবোধ এবং চেতনা একটি সময়ে নষ্ট করার পাঁয়তারা শুরু হয়। ‘আমলাতন্ত্রের’ বীজ বপন করা হয়। অপ্রিয় হলেও সত্যি, এ খেলার কুশলী খেলোয়াড়দের কারও কারও পরিচিতিতে খেলোয়াড়ী জীবন ছিল। এরা ব্যক্তি এবং সমষ্টির স্বার্থ রক্ষা এবং এ চত্বরে ‘ছড়ি’ ঘোরানোর লক্ষ্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আদর্শ এবং নীতি ধ্বংস করতে দ্বিধা করেননি। এরা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে নিজেদের সব সময় বড় মনে করেছেন।
এতে পুরোনো সংগঠকরা বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে একটি সময় থেকে ধীরে ধীরে অনেকেই ক্রীড়াঙ্গন থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এদের শূন্যস্থানে যাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে এদের একটি বড় অংশ সাংগঠনিক যোগ্যতা এবং দক্ষতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকায় দেশের বিভিন্ন খেলার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত এবং স্থবির হয়েছে। এটিকে ক্রীড়াঙ্গনের জন্য বড় একটি ধাক্কা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ক্রীড়া গবেষক এবং বিশ্লেষকরা।
সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন অনেক ব্যক্তিত্ব ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থেকে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই ব্রিটিশ শাসনের দিনগুলো থেকে শুরু করে অখণ্ড ভারত বিভক্ত হয়ে নতুন দেশ পাকিস্তান এবং এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতে এর ব্যতিক্রম হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম থেকেই ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন এমন অনেক ব্যক্তিত্ব যারা সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এরা ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন খেলার সংস্থা এবং ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ক্রীড়া সংগঠক পরিচয় নিয়ে। ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে এদের ছিল আবেগ এবং ভালোবাসার সম্পর্ক। এরা তাদের দলীয় চিন্তা-চেতনা কখনও ক্রীড়াঙ্গনে টেনে আনেননি। এটি ছিল বহুমতের ক্রীড়াঙ্গনে আসল সৌন্দর্য। ক্রীড়াঙ্গনে প্রত্যেকের পরিচয় তো নির্দিষ্ট আর তা হলো খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক এবং ক্রীড়ানুরাগী।
সময়ের ব্যবধানে মূল্যবোধ, আদর্শ, নৈতিকতা এবং নীতি ক্রমেই দূরে চলে গেছে। সচেতন মহল একটি সময় থেকে লক্ষ করেছে ক্রীড়া সংস্থা এবং ক্লাব সংগঠনগুলো শাসক দলের দলীয় রাজনীতির প্রভাব এবং প্রতিপত্তি। সময় গড়ানোর সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনে দলীয় ‘রাজনীতির দাপট’ রোগটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। ক্রীড়াঙ্গনের ‘সব বড় তাল গাছ’গুলোর মালিক বনে গেছেন শাসক দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং তাদের ‘চামচারা’। এ ক্ষেত্রে ‘পল্টি’ দিয়ে অনেকেই সময়ের সন্তান বনে গেছেন।
বিভিন্ন সময় জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহারে উল্লেখ করেছে, ‘ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতির সুযোগ নেই’। ক্রীড়াঙ্গন পরিচালিত হবে প্রকৃত সংগঠকদের দ্বারা। নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার পর এ প্রতিশ্রুতি বারবার ভুলে যাওয়া হয়েছে। বারবার নতুন সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের আগেই লক্ষণীয় হয়েছে দলীয় রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন খেলায় ফেডারেশন এবং অ্যাসোসিয়েশন পদ দখলের পাঁয়তারা।
ছয় মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। জাতীয় নির্বাচনের তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। শোনা যাচ্ছে, রাজনীতিবিদদের মতৈক্যে ঠিক হবে নির্বাচনের তারিখ। রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হয়েছে, ‘আগামীতে ক্রীড়াঙ্গনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে ফায়দা লোটার আর সুযোগ দেওয়া হবে না। ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনা করবেন ক্রীড়া সংগঠকরা।’ নির্বাচনের পর কথাগুলো মনে রাখলে ক্রীড়ামোদী সমাজ খুশি হবে।