পুলিশে সংস্কার
খন্দকার ফারজানা রহমান
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:৩১ এএম
খন্দকার ফারজানা রহমান
দেশের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে নানা সংস্কারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত ১৫ জানুয়ারি জমা দেয়া সুপারিশে পুলিশ পরিচালনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত পুলিশ কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়াও পুলিশ সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে পুলিশের সংস্কারের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের ওপর অযাচিতভাবে আক্রমণ করা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বিচার নিশ্চিত করা, স্বচ্ছ কাচের ঘরে রিমান্ডের সুপারিশ অন্যতম। কিন্তু বর্তমানে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি ঘটায় দ্রুত কিছু কার্যক্রম নেওয়া জরুরি। পুলিশ বাহিনীকে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে যতটা সক্ষম করা দরকার, সে বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
আমরা দেখেছি, গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পটপরিবর্তনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে, সাধারণ মানুষের দাবি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ পুলিশ দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তাই এ আইনগুলো বাংলাদেশে একটি আধুনিক জনবান্ধব পুলিশিং গড়ে তুলতে সক্ষম কি না তা নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ পুলিশ মূলত ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন দ্বারা পরিচালিত, এর সঙ্গে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি; সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২; পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল, ১৯৮৩ এবং অন্যান্য বিশেষ আইন দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হয়। ১৯৭৬ সালে সরকারি বিভিন্ন কমিটিতে পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়োগব্যবস্থা পৃথক্করণ, পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়। এরপর ১৯৮৮ সালের কমিশন পুলিশের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছিল, যার মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত পুলিশের অভাব, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অপসংস্কৃতি, জনগণের আস্থার অভাব, ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগনীতি, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং দুর্নীতি।
দুঃখজনক হলেও সত্য, পুলিশের বর্তমান অবস্থা একদিকে যেমন রাজনৈতিক শোষণ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার ফল, তেমন অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ অফিসার আইনের শাসন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর জনগণের অধিকার হরণ করেছে। পরবর্তীতে জাতীয়ভাবে পুলিশ সংস্কার প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেখানে কমিউনিটি ব্যবহারের পাশাপাশি পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আইসিটি অবকাঠামোর উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। একইসঙ্গে একটি পুলিশ অর্ডিন্যান্স খসড়া নীতি ২০০৭ চূড়ান্ত করা হয়, যেটি বাংলাদেশে পুলিশের সাংগঠনিক এবং সাংস্কৃতিক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত, জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক করতে এবং বাহিনীর পরিবর্তিত মানসিক কাঠামোর সঙ্গে, পেশাগত দায়িত্বের দিক থেকে আরও দক্ষ করে তুলতে পারে। পুলিশ অধ্যাদেশে যদিও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবিধান যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু এ আইনটি কার্যকর না হওয়ায় পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা এবং পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে জনগণকে নিপীড়ন করা বাহিনীর মৌলিক নীতিগুলোর অংশ হয়ে রয়েছে।
এ অবস্থায় বর্তমান পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের যে সারসংক্ষেপের বিবরণ সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে জানা যাচ্ছে সংস্কার কমিশন পুলিশের বলপ্রয়োগের বিষয়টিকে সবার শুরুতে রেখেছে। এক্ষেত্রে মূলত পুলিশ প্রবিধান অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ঠিক রেখে ‘ইউজ অব ফোর্সের’ পাঁচটি ধাপ সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশে রেখেছে। ধাপগুলো হলো শারীরিক সংস্পর্শ ছাড়া অবৈধ জনতাকে বাধা প্রদান, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা, বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে অবৈধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা, স্বল্প বা ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার এবং দলগত অস্ত্রের ব্যবহার। কমিশনের সুপারিশে শুধু পুলিশ সদস্যদের বা ব্যক্তির আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগের জন্য জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করার অধিকারও সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাবের কথা সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
মূলত পুলিশের আগ্রাসি ভূমিকার কারণে সাধারণ মানুষ এবং পুলিশের মধ্যে বিশ্বাসহীনতার সুযোগ ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে। সেজন্য জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন জরুরি। আমাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে, দেশে পুলিশের উল্লেখ করার মতো সাফল্য আছে। দেশের পুলিশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, পুলিশের বর্তমান অবস্থা একদিকে যেমন রাজনৈতিক শোষণ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার ফল, তেমন অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ অফিসার আইনের শাসন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর জনগণের অধিকারহরণ (কখনও অসদাচরণ, গুম, অকারণে মামলার আসামি) করেছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশে যে মৌলিক সংস্কার জরুরি তার মধ্যে অন্যতম হলো পুলিশের মধ্যে থাকা সাব-কালচারের প্রভাব দূর করা। অতীতে পুলিশের ওপর কখনও কখনও মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতের অসংখ্য অভিযোগ এলেও দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দায়মুক্তির এ প্র্যাকটিসগুলো সাংগঠনিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ও তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে অসদাচরণ তদন্ত ও অনুসন্ধানের জন্য বেসামরিক রিভিউ বোর্ড বা স্বাধীন সংস্থা আছে; যেগুলো পুলিশি কার্যক্রমের তদারকি করে। এ ধরনের ব্যবস্থা পুলিশের জনসাধারণের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে সাংগঠনিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের আস্থা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই দেশে স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে পুলিশের অসদাচরণের তদন্ত পর্যবেক্ষণ এবং তার নিয়মিত প্রতিবেদনসহ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হওয়া উচিত। আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনী প্রায়ই তার পেশাদারির অভাবের জন্য সমালোচিত হয়, অনেক কর্মকর্তা মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা বা ডি-এস্কেলেশন কৌশলগুলোয় অপ্রশিক্ষিত। যেহেতু অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে পুলিশ নিয়োগ ও প্রমোশন দেওয়া হয়, অনেক অফিসারই আধুনিক পুলিশিং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ নন। পুলিশ নিয়োগের পর বিশ্বের অনেক দেশে তিন থেকে ছয় মাসের পুলিশ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। শারীরিক তৎপরতা, শক্তি, ফিটনেস এবং এর পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক বা অন্যান্য পরীক্ষারও প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে দক্ষ করে তুলতে হলে অবশ্যই বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ যেমন উত্তপ্ত পরিস্থিতি কমাতে এবং শক্তির ব্যবহার রোধ করার কৌশলগুলোর প্রশিক্ষণ, নিরাপদ থাকার কৌশলগুলোর প্রশিক্ষণ, অন্তর্নিহিত পক্ষপাত দূরীকরণ এবং জাতিগত সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ, ট্রমাজনিত পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়, মানবাধিকার, নৈতিক আচরণ, বিরোধ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এবার আসা যাক পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। শুধু যোগ্য এবং সক্ষম ব্যক্তিদের একটি স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থার মাধ্যমে এ পেশায় যুক্ত করতে হবে। কর্মকর্তা বাছাইয়ে কঠোর নিরীক্ষা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নতুন নিয়োগকারীদের অপরাধমূলক ইতিহাস, আর্থিক রেকর্ড, মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়নসহ ব্যাপক পটভূমি পরীক্ষা করে উপযুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিদের পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জর্জরিত বর্তমান ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং পুলিশ যাতে সততার সঙ্গে জনসাধারণের সেবা করে তা নিশ্চিত করার জন্য টেকসই সংস্কার প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে, দেশের পুলিশ এবং জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি না হলে কখনোই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কমিউনিটি পুলিশিং, যার মধ্যে পুলিশ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করতে, বিশ্বাস পুনর্নির্মাণ করতে, আইন প্রয়োগকারী এবং জনসাধারণের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। জননিরাপত্তামূলক যেকোনো কার্যক্রমে কমিউনিটি পুলিশিংয়ে স্থানীয় সংস্থা, নারী, যুবক শ্রেণি এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে অংশীদারি গঠন করা উচিত। দেশের প্রেক্ষাপটে ২৪ ঘণ্টা নিযুক্ত একটা পেশা এবং অপরাধ দমন, তদন্তসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে পুলিশের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হয়, তাই কাজের কর্মঘণ্টা কমিয়ে কিংবা বেতন বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা বাড়াতে হবে এবং এ পেশাকে রাষ্ট্রের যতটুকু সম্ভব সম্মান দিতে হবে। একই সঙ্গে পুলিশ স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট উন্নত করার জন্য সাংগঠনিকভাবে কিছু কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যেমন মননশীলতা অনুশীলন, পিয়ার সাপোর্ট গ্রুপ মিথস্ক্রিয়া, রিলাক্সেশন ট্রেনিং, প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বা থেরাপি নেওয়া, সহকর্মীদের এবং নেতৃত্বের সঙ্গে খোলা যোগাযোগ প্রভৃতি। তাহলে পুলিশ পেশার জটিল প্রকৃতির সঙ্গে অফিসাররা আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন।
দেশের পুলিশ বাহিনী সংস্কার সময়সাপেক্ষ। দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জর্জরিত বর্তমান ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং পুলিশ যাতে সততার সঙ্গে জনসাধারণের সেবা করে তা নিশ্চিত করার জন্য টেকসই সংস্কারের প্রয়োজন। একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার, কমিউনিটি পুলিশিং প্রয়োগ করে বাংলাদেশ একটি সৎ ও দক্ষ পুলিশ বাহিনী তৈরি করতে পারে; যা ভবিষ্যতে তার নাগরিকের চাহিদার প্রতি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। তাই পুলিশ সংস্কার কমিশন ওপরের বিষয়গুলো মাথায় রেখে তাদের গঠনমূলক সুপারিশের মাধ্যমে বাংলাদেশে শক্তিশালী ও জনমুখী পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।