× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অতিথি পাখির নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা জরুরি

দুলাল আচার্য

প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:২৮ এএম

অতিথি পাখির নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা জরুরি

‘হাজার মাইল পথ পেরিয়ে/এসেছে অতিথি পাখি,

নদী-নালা খাল-বিলে যে/ওদের দেখে জুড়াই দু’আঁখি।’

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সবুজ আশ্রিত আমাদের দেশ। এখানে ভোরে ঘাস-গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু আর শীতল হাওয়ায় ভর করে আসে শীত। আর এ শীতের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অতিথি পাখি নামটি। পাখিদের কোনো সীমান্তরেখা নেই, নেই বিচরণে সীমান্তরক্ষীর বাধাও। তারা অনায়াসে উড়ে বেড়ায় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে। প্রতি বছর শীতকাল এলেই নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, মোহনা-চরাঞ্চল-দ্বীপ, পুকুর-জলাশয় ভরে যায় নানা রঙবেরঙের নাম জানা না জানা পাখিতে। এদের আদর করে আমরা অতিথি পাখি বলি। এ পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দেশে হাজির হয় জীবনের তাগিদে। ঝড়বৃষ্টি, তুষারপাতসহ প্রকৃতির হাজারো প্রতিকূলতা পেরিয়ে তারা পাড়ি জমায় হাজার হাজার মাইল দূরের দেশে। কবির কবিতার পঙ্‌তির মতো।

এখন শীতের মৌসুম যাই যাই করছে। চারদিকে পাখির কোলাহল। অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ায় সুখ অনুভব করতে, হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ আর ঠান্ডা রোদের দেশ বাংলাদেশে। আসে খাবার আর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। এ সময় তাদের আবাসস্থল সাইবেরিয়াসহ শীতপ্রধান অন্যান্য দেশের তীব্র শীতে তাদের টিকে থাকা কষ্টকর। শুধু তাই নয়, এ সময়টায় তীব্রভাবে খাদ্যসংকটও দেখা দেয়। আমাদের দেশে শীতের সময় জলাশয়গুলোর পানি কমে যায় এবং সে সময়ের কচিপাতা, শামুক, ঝিনুকসহ কিছু উপাদান এসব পাখির প্রিয় খাবার। সে কারণে জলাশয়গুলো হয়ে ওঠে তাদের খাবারের উপযোগী স্থান। তাই বেঁচে থাকার একটি উপযোগী এলাকা খুঁজতে খুঁজতেই এসব পাখি এ অঞ্চলে আসে।

বাংলাদেশে দুই শ্রেণির পাখির বিচরণ। আবাসিক আর অনাবাসিক। অতিথি পাখি অনাবাসিক শ্রেণিভুক্ত। অনেকে অতিথি পাখিকে পরিযায়ী পাখিও বলেন। সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দলবেঁধে আসতে শুরু করে এসব পাখি। মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত কলকাকলিতে আমাদের প্রকৃতি ভরিয়ে রাখে। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে ১০ হাজারের বেশি প্রজাতির পাখি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির পাখি পরিযায়ী। একসময় ধারণা ছিল সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখিগুলো বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এখন ভিন্নমত পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ বলেন পাখিগুলো আসে উত্তর মঙ্গোলিয়া, তিব্বতের একটি অংশ, চীনের কিছু অঞ্চল ও সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে। অর্থাৎ উত্তর মেরু, ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু এলাকা এবং হিমালয় পর্বতমালার আশপাশ থেকেই পাখিগুলো ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশে আসে। এসব অঞ্চলে তুলনামূলক ঠান্ডা কম পড়ে ও খাবার পাওয়া যায়। শীতটা শেষে আবার পাড়ি জমায় নিজ দেশে। এরা যাযাবর স্বভাবের। জানা গেছে, শতকরা ১৯ প্রজাতির পাখি সমগ্র বিশ্বে যাযাবরের মতো বিচরণ করে। তার মধ্যে প্রায় ২৩০ প্রজাতির পাখি আসে বাংলাদেশে। দেশি এবং পরিযায়ী মিলিয়ে বাংলাদেশে বিচরণ করে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি। আন্তর্জাতিকভাবে জলচর পাখির জন্য স্বীকৃত ২৮টি স্থান বাংলাদেশের সীমানায় রয়েছে। তাই হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসে নাম না জানা এসব পাখি। এখানে উল্লেখ্য, প্রতি বছর মে এবং অক্টোবরের দ্বিতীয় শনিবার বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

পরিসংখানে বলছে, ১৯৮০ সাল থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানার সরোবরে অতিথি পাখির দেখা মিলছে। পরে দেখা মিলছে নীলফামারীর নীলসাগর, নিঝুম দ্বীপ, হাকালুকি হাওর, বরিশালের দুর্গাসাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাটল হাওর ও সোনাদিয়ায়। অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। এসব পাখি রাত-দিন মিলিয়ে একটানা ৬ থেকে ১১ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম। দেখা যায়, শুধু হাঁস গোত্রের পাখিরাই ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে। প্লোভার গোত্রের পাখিরা একটানা উড়তে পারে ১১ ঘণ্টা। তাতে পাড়ি দেয় ৮৮০ কিলোমিটার।

পাখি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের ভাষ্য, অতিথি পাখির মধ্যে সোনাজঙ্গ, খুরুলে, কুনচুষি, বাতারণ, শাবাজ, জলপিপি, ল্যাঞ্জা, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, রাজশকুন, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু, জঙ্গি বটের, ধূসর বটের, হলদে খঞ্জনা, কুলাউ ইত্যাদি। হাঁসজাতীয় এমন পাখি শীতকালে বাংলাদেশে আসে। লাল বুকের ক্লাইক্যাসার পাখি আসে ইউরোপ থেকে। অন্য পাখিরা আসে পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে। বাংলাদেশের অতি পরিচিতি অতিথি পাখি নর্দান পিনটেইল। এ ছাড়া রয়েছে স্বচ্ছ পানির খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনোহাঁস, ছোট সারস, বড় সারস, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, বিলুপ্তপ্রায় প্যালাস ফিশ ঈগল (বুলুয়া)। রয়েছে নানা রঙ আর কণ্ঠবৈচিত্র্যের ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালিহাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশির পিয়াং, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি। কয়েক বছর আগেও এ দেশে ২০০ থেকে ২১৫ প্রজাতির অতিথি পাখি আসত। এ সংখ্যা প্রতি বছরই হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাপকহারে পাখি শিকার ও জলাভূমির সংখ্যা কমে যাওয়া অন্যতম কারণ বলে ধরা হয়।

এ কথা সত্য, এ সময়টায় কিছু অসাধু চোরাকারবারি ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে। রয়েছে শৌখিন ও পেশাদার পাখি শিকারিও। যারা বন্দুক, বিষটোপ, জাল ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে। আবার শীতের সময় পাখি শিকার কারও কারও পেশাও। পেশা হিসেবে যারা নেয়, তারাই অতিথি পাখির জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর। ফলে অতিথি পাখি নিরাপদে কোথাও বসতে পারে না। মোবাইল ফোনের টাওয়ারের সংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। ফলে মাত্রাধিক তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণও পাখির সংখ্যা হ্রাসের কারণ হিসেবে বলা হয়। এর প্রভাবে যেসব পাখি প্রজননের জন্য এ দেশে আসে তাদের সে সক্ষমতাই হারিয়ে যাচ্ছে, নষ্ট হয় ডিম। ইদানীং আরও একটি ব্যাপার চোখে পড়ছে। কোনো ঝিল বা বিলের কাছে শান্ত পরিবেশে পরিযায়ী পাখিরা আশ্রয় নিলেই তাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে পিকনিক স্পট। অহেতুক হইহুল্লোড় ও আধুনিক ডিজে বক্সের ভয়ানক আওয়াজে পরিবেশ হয়ে উঠছে তাদের জন্য অশান্ত। কিছু মানুষ ইটপাটকেল ছুড়েও পাখিদের বিচরণ বাধাগ্রস্ত করে থাকে। পাখিপ্রেমীদের মতে, ‘কাক, শালিক, বক, চড়ুই, দোয়েল জাতীয় দেশি পাখি সব সময় দেখা যেত। এখন শহরের পাশাপাশি গ্রামেও পাখির সংখ্যা কমে এসেছে, যা আমাদের সবার জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়।’

পাখি শিকার বা হত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ। বন্য প্রাণী ও অতিথি পাখি সংরক্ষণের জন্য দেশে অনেক আগে থেকেই আইন রয়েছে, ব্রিটিশ আমলেও বিশেষ আইন ছিল। ১৯৭৪ সালের বন্য প্রাণী রক্ষা আইন এবং ২০১২ সালের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের জেল, ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে। আইন অনুযায়ী, আমাদের দেশের বহু মানুষ এখনও জানে না পাখি শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই এ চিত্র প্রতি বছরের। আইনে আছে পাখি শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আইনের প্রতি অনুগত নয়। প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ আইন যেন কাগজেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাস্তবে এ আইনের কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না। যদি প্রয়োগ হতো, তাহলে এভাবে অতিথি পাখি শিকার হতো না।

পাখি রক্ষা করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। যেকোনো মূল্যে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাখি শিকার বন্ধে সচেতন হওয়া জরুরি। পাখি শিকার জীববৈচিত্র্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। এ ক্ষতি রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল বাড়ানো, শিকারিদের ধরার জন্য বিশেষ অভিযান এবং কার্যকরভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতাও অধিকতর ভূমিকা রাখতে পারে। জনগণকে আরও সচেতন করতে হবে। সব ধরনের পাখি শিকার বন্ধে র‌্যালিসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জরুরি স্থানীয় লোকজনের সচেতন হওয়া। সচেতনতা ছাড়া কোনোভাবেই পাখি শিকার বন্ধ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, এরা আমাদের সম্পদ। এদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা