× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পর্যবেক্ষণ

শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:০২ এএম

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছে প্রতিটি সেক্টরে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক দিন থেকেই শিক্ষা নিয়ে আমাদের বিভিন্ন ধরনের আশঙ্কা ছিল। এখন সে আশঙ্কাগুলো অধিকভাবে সামনে আসছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু এ চিন্তা সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক গুণে বেড়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঠিকভাবে গড়ে উঠছে কি-না কিংবা তাদের ভবিষ্যৎ কীÑ এসব বিষয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ালেখার ব্যবস্থাপনা, মান এবং পরিবেশ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া আমার কাছে মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অনেকেরই আচার-আচরণ, আনুগত্যশীলতা, পড়ালেখার মান এবং পড়ালেখার আগ্রহেও পরিবর্তন লক্ষণীয় মাত্রায় দৃশ্যমান হয়েছে। আগে যেভাবে পড়াশোনার ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের ভারসাম্য ছিল, তার অবক্ষয় সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, আমরা দেখেছি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কেও এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভক্তি, স্নেহ-ভালোবাসায়ও প্রভাব পড়েছে। রাজনৈতিক আদর্শ, দর্শন প্রভৃতি কারণে শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যেও এক ধরনের বিভেদ ও অসহিষ্ণু মনোভাব দেখা যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ করেছি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়Ñ প্রতিটি পর্যায়ে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক শিক্ষককে হেয় হতে হয়েছে। এ কথা সত্য, অনেক শিক্ষকেরই রাজনৈতিক মতাদর্শগত বাড়াবাড়ি, অপচর্চা ছিল এবং আছে। কিন্তু এর বাইরেও স্বাভাবিক রাজনৈতিক আদর্শচর্চা কাঙ্ক্ষিত হিসেবে ধরা যায়। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক আদর্শ থাকবে, সেগুলোর চর্চা থাকবে; সেটি খুব ন্যায্য এবং প্রত্যাশিত। তবে শিক্ষকদের রাজনীতির দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে কোনো কোনো সময়ে তার প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর পড়েছে এবং এখনও পড়ে যাচ্ছে। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিংবা ভবিষ্যতেও আবার একই ধরনের প্রভাব পড়বে সেটিও কাম্য নয়। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি যে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের রাজনৈতিক আদর্শ বিবেচনায় নিয়ে অনেককে হেয় করেছে এবং করে যাচ্ছে।

আবার এ কথাও সত্য, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকদের মাথার তাজ বানিয়ে রেখেছে। অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে নৈতিকতা স্খলনের অভিযোগ উঠেছে। যদিও সেগুলো তদন্তাধীন বিষয়। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শের কারণে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার বিষয়টি মোটেও শোভনীয় মনে হয়নি। তবে অনেক শিক্ষক রয়েছেন, যাদের আচরণ শিক্ষকসুলভ নয়, যারা নিজেদের শিক্ষকতার চেয়ে দলবাজিতে ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করেন; তাদের বিষয়ে সমালোচনা তৈরি হওয়া অন্যায্য কিছু ছিল না।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এ কথা অনুমান করা যায় যে, শিক্ষার্থীরা নিজেদের মূল লক্ষ্য থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, অনেক শিক্ষার্থী ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাঠে নামছে। কখনও রেজাল্টের দাবিতে, কখনও পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে তারা রাজপথে নামছে, সচিবালয় ঘেরাও করছে। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়েও রেজাল্ট কিংবা পরীক্ষা আগানো-পেছানোর বিষয়েও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা মুখ্য হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেটি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে শিক্ষাব্যবস্থার যে আদর্শিক চেইন অব কমান্ড ছিল তা নষ্ট হচ্ছে।

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমরাও অনেক চিন্তাভাবনা করে ক্লাসে কথা বলি। মনে হয় যেন কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনোভাবে কোনো কথায় মনঃক্ষুণ্ন হয় কিংবা তার রাজনৈতিক আদর্শের বাইরে কোনো মতামত তাকে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত করে তাহলে সেটি অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এমন অনেক শিক্ষকই আছেন যারা চান না যেÑ তার কোনো বিষয়ে কোনোভাবে মতামতের ভিন্নতা তৈরি হয়। আমি আমার শিক্ষার্থীর কাছেই জেনেছি যে, আমার বিভাগের বেশ কিছু শিক্ষার্থী আমার দুয়েকজন সহকর্মীর ক্লাসে দেওয়া মতামত নিয়ে অভিযোগ করেছে। অথচ আমার দেড় যুগের বেশি সময়ের শিক্ষকতার ইতিহাসে ক্লাসে মতামত দেওয়া নিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার বিষয়টি আগে কখনও শুনতে পাইনি। হয়তো অন্য কোনো নৈতিক ইস্যুতে অভিযোগ থাকতে পারে। সেটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ক্লাসে দেওয়া মতামতেও যদি অভিযোগ তৈরি হয়, তবে সেটি কতটা শোভনীয় ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে আমি এও দেখেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও রেজাল্ট সিজিপিএ কমবেশির ইস্যুতে শিক্ষকদের কেউ কেউ অপমানিত হয়েছেন তাদের নিজেদের দুয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছে।

শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত উত্তেজিত হয়ে থাকছে, দেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবছে, এমনকি রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছে। রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া ভালো কিন্তু পড়ালেখা, ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত এবং যথাযথভাবে করার পাশাপাশি সেগুলো সঠিক এবং ন্যায্যতার প্রশ্নে করা উচিত। ছোটখাটো বিষয়ে পড়াশোনা বাদ রেখে রাজপথে সব সময় আন্দোলনে থাকলে শিক্ষার্থীরা তাদের সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে কি-না তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। গত কয়েক মাসে আমরা অসংখ্যা ঘটনা দেখেছি যেগুলো নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছে। আমরা দেখলাম, ঢাকার সাত কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা এবং সংঘাত, বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা মহাখালীতে রাজপথ-রেলপথ অবরোধের সময় ট্রেনে হামলা, ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে সিটি কলেজের ছাত্রদের সংঘাত এবং পুরান ঢাকার কবি নজরুল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের সঙ্গে যাত্রাবাড়ীর মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সংঘাত। মোটামুটি ঘোষণা দিয়ে এসব সংঘাত ঘটতে দেখা গেছে। ঢাকার বাইরেও এমন ঘটনা ঘটছে অসংখ্য। সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে দেশজুড়ে। আমার মনে হয় যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তরুণ, কিশোর শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে, সে পরিবেশ বা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে এর আগে তারা কখনও গিয়েছে কি না তা একটি বড় প্রশ্ন। মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, শিক্ষার্থীদের এমন উত্তেজনা কিংবা জবাবদিহি না থাকার বিষয়টি কি ভবিষ্যতের জন্য শুভলক্ষণ তৈরি করছে?

তবে দেশের পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় অনেক শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান হতাশা জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তরুণদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সঙ্গে আমাদের সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় যদি যথাযথভাবে ঘটে তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা অনেকাংশে কমে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী তার স্বপ্নগুলো লালন করতে করতে পড়ালেখা যখন শেষ করে সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি অর্জন করে তখনই শুরু হয় তার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। অনেক ছোট ছোট যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সম্মুখীন হয় একটি বড় যুদ্ধের। আর এ যুদ্ধে যথাযথভাবে বিজয়ী হলেই কেবল তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় ঘটতে পারে। এমনকি এমন সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে দেশে একটি স্থিতিশীল সামাজিক শৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। কিন্তু আমার প্রশ্নÑ শতকরা কতভাগ শিক্ষার্থী তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়? এ ধরনের সমন্বয় ঘটাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীই ব্যর্থ নাকি আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা? আমরা লক্ষ করি, একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন শেষে চাকরির বাজারে এসে আশানুরূপভাবে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পেতে হিমশিম খেয়ে যায়। এমনকি অনেকেই মুখথুবড়েও পড়ে। অনেকেই দিশাহারা হয়ে ওঠে। এমনও পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, তিনি কোথায় কী করবেন তার কিনারা খুঁজে পান না। এমন সময় তাদের সামনে থাকে শুধু হতাশা, লজ্জা আর গ্লানি।

তবে আমাদের আরও কিছু বিষয়ে ভাবতে হবে। কারণ আমাদের যে প্রত্যাশা সে অনুযায়ী শিক্ষাকাঠামো যথাযথভাবে সাজানো হচ্ছে কি না, নাকি গুণগত মান বিবেচনা না করে পরিমাণগত বৃদ্ধির প্রবণতায় ঝুঁকে পড়েছি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় যে, দেশে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তবে উচ্চশিক্ষার মান বাড়ছে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রচলিত উচ্চশিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই কর্মবাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বিশেষায়িত দক্ষতার ঘাটতি। আর এ ঘাটতির কারণে উচ্চশিক্ষার পরও ভালো কাজ পাচ্ছেন না স্নাতকরা। সারা বিশ্বে কর্মমুখী শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আমরা এখনও পিছিয়ে। সার্বিকভাবে দেশে শিক্ষা পরিস্থিতি এখন এতটাই বেহাল দিকে যাচ্ছে যে, এটিকে নাজুক না বলে রীতিমতো ভয়ংকর ও উদ্বেগজনক বলেই অভিহিত করা যেতে পারে।

  • অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা