× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য

অপ্রত্যাশিত বিতর্কের মীমাংসা জরুরি

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৪১ এএম

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রসঙ্গ আসতে শুরু করে, তখন জনপ্রশাসন সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। সে দাবির প্রতি সম্মান রেখে অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের অক্টোবরে দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ, স্বচ্ছ ও জনমুখী প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশন তাদের সুপারিশমালা চূড়ান্তভাবে উপস্থাপন করবে, এটাই ছিল প্রাথমিক পরিকল্পনা। তবে পরিকল্পনামাফিক জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এখনও তাদের চূড়ান্ত সুপারিশমালা জমা দেয়নি। এ জমা না দেওয়ার পেছনে যে কারণগুলো সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে তা কিছু বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, সংস্কার কমিশনের তিনটি সুপারিশ কেন্দ্র করে প্রশাসন ক্যাডার, অন্য ২৫টি ক্যাডার ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মধ্যে ত্রিমুখী মতবিরোধ দেখা দেয়। সুপারিশগুলো হলো উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ এবং অন্য ২৫টি ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ নিয়োগ; উপসচিব পদে পদোন্নতির জন্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক এবং  স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ক্যাডার হিসেবে না রাখা। কমিশনের এ সুপারিশমালা, যা নিয়ে দ্বন্দ্ব, তা চূড়ান্তভাবে জমা না হলেও সংবাদমাধ্যমের কারণে প্রকাশ্যে আসাতেই আন্তঃক্যাডার বৈষম্য সামনে রেখে মতবিরোধ।

‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে একটি ধারণাগত ত্রুটি রয়েছে। সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক সব সাধারণ ক্যাডারের জন্য একটি এবং প্রতিটি টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য আলাদা মেধা তালিকা প্রণয়ন করা হয়। কারণ সাধারণ ক্যাডার এবং টেকনিক্যাল ক্যাডারের চাকরিপ্রার্থীরা অভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নেন না। অথচ বৈষম্যের বিষয়টি বিবেচনা করতে হয় একই শ্রেণিভুক্তদের মধ্যে। সিভিল সার্ভিসে নিয়োগলাভের সময় নিজের পছন্দের ক্রম এবং মেধা তালিকায় মোট প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে কর্মকর্তারা বিভিন্ন ক্যাডারে ভাগ হন। যেমন, পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক পদের জন্য শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানেই স্নাতক সম্পন্ন করেছেন এমন প্রার্থীরাই প্রতিযোগিতা করেন। এজন্য টেকনিক্যাল ক্যাডারের একটি পদের জন্য প্রতিযোগিতা সাধারণ ক্যাডারের পদের তুলনায় অনেক সীমিত থাকে। সে বিবেচনায় একজন টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তা যাকে একটি সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্ট হিসেবে সীমিত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়; চাকরির মাঝামাঝি এসে তাকে ভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী একটি সাধারণ ক্যাডারের পদে বসার সুযোগ করে দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থি কি না ভেবে দেখা জরুরি। তাই ২৫% ডিএস পুলে অন্য ক্যাডার থেকে প্রশাসন সার্ভিসে প্রবেশের সুযোগ থাকতে পারে কেবল সাধারণ ক্যাডারের (পররাষ্ট্র, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্স, আনসার, সমবায়, খাদ্য, পরিবার পরিকল্পনা, নিরীক্ষা ও হিসাব ইত্যাদি) কর্মকর্তাদের; যারা সরকারি কর্ম কমিশনের অভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আদেশের পর্যবেক্ষণে এ বিষয়টি উল্লেখ আছে।

সাধারণত ১২-১৪ বছর কাজ করার পর প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। এ সময়ের মধ্যে একজন কর্মকর্তা বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনের নানান বৈচিত্র্যময় প্রশাসনিক এবং সমন্বয়মূলক কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ লাভ করেন। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় তারা সেই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নীতি প্রণয়নে অবদান রাখেন। কেবল প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই মাঠ পর্যায়ে সরকারের প্রায় সব নীতি বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত থাকেন; যা অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসের থেকে আলাদা। কারণ, অন্যান্য সার্ভিসের কর্মকর্তারা শুধু নিজ বিভাগের কাজের ওপর বিশেষায়িত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। যেমন, একজন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা যিনি ১৪-১৫ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের শুধু রসায়ন পড়িয়েছেন অথবা একজন চিকিৎসক যিনি সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সেবা দিয়েছেন; হঠাৎ তাকে উপসচিব বানিয়ে দেওয়া হলো। এমন কাজের উভমুখী নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। একদিকে তিনি যে টেকনিক্যাল পদ ছেড়ে যাচ্ছেন সেই সার্ভিস তার এতদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে, অন্যদিকে উপসচিব হয়ে উনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার কাজ সম্পর্কে তার তেমন কোনো ধারণা বা অভিজ্ঞতা নেই। এ ব্যবস্থা দুই দিক থেকেই সরকারের জন্য মেধা এবং অভিজ্ঞতার অপচয়। বিশালসংখ্যক সার্ভিসের সবাইকে সিভিল সার্ভিসভুক্ত করে একই কাতারে এনে বিসিএস ব্র্যাকেট ক্যাডার ব্যবস্থা চালু করার ফলে এখন সবাই নিজেদের সমান মনে করে একে অন্যের সঙ্গে তুলনায় ব্যস্ত। অন্যদিকে একসময়ের বিচার ক্যাডার বর্তমান জুডিসিয়াল সার্ভিসের প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ আলাদা বেতন কাঠামো নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা বা তুলনায় নেই; কারণ, তারা এ ব্র্যাকেট ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন।

পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন, ১৯৭৭-এর সুপারিশের আলোকে ১৯৭৯ সালে সিনিয়র সার্ভিসেস পুল (এসএসপি) আদেশ জারি হয়। সে আদেশ আনুযায়ী সব ক্যাডারের মধ্যে সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে উন্মুক্ত পরীক্ষা এবং পরিকল্পিত অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে উপসচিব পদে নিয়োগদানের বিধান রাখা হয়। আর এর মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় উপসচিব পদসংক্রান্ত আজকের এ বিতর্ক। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে বর্তমানে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে যাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ ক্ষেত্রভিত্তিক পদ নির্ধারিত এবং সে পদ সোপান ধরে তাদের পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে। সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যে কর্মকর্তা আজ যোগদান করেন, তিনি জানেন একদিন তার পুলিশের শীর্ষপদ আইজিপি পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তেমন একজন সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী নবীন কর্মকর্তার লক্ষ্য থাকে তিনি একদিন নিজ বিভাগের শীর্ষপদ অর্থাৎ প্রধান প্রকৌশলী হবেন। প্রশাসন ক্যাডারও তার ব্যতিক্রম নয়। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে যে নবীন কর্মকর্তা প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন তিনিও একদিন একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সম্প্রতি প্রশাসনের পাঁচ গ্রেডের পদ উপসচিব নিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তার মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরোধ পরিষদের ব্যানারে প্রশাসন বাদে বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন উপসচিব পদটি সব ক্যাডারের সদস্যদের জন্য উন্মুক্ত করে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের জন্য আন্দোলন করছে। তাদের যুক্তি, উপসচিব কোনো নির্দিষ্ট ক্যাডারের পদ নয়, এটি সরকারের পদ তাই সিভিল সার্ভিসের যেকোনো ক্যাডারের কর্মকর্তা এ পদে নিয়োগলাভের সমান অধিকার রাখেন।

এসএসপি আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব এ সব পদ পুলভুক্ত করা হয়; অর্থাৎ এ পদগুলো কোনো নির্দিষ্ট ক্যাডারের পদ হিসেবে বিবেচিত হবে না বরং সিনিয়র সার্ভিস পুলভুক্ত সরকারের পদ হিসেবে গণ্য হবে যেখানে সব প্রথম শ্রেণির সার্ভিস থেকে কর্মকর্তারা পরীক্ষার মাধ্যমে পুলভুক্ত হয়ে নিয়োগলাভের সুযোগ পাবেন। অথচ প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা চাকরির শুরু থেকেই বিসিএস প্রশাসন অ্যাকাডেমিতে আইন, প্রশাসন কোর্সসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে নিজেকে মাঠ প্রশাসনের আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সুযোগ পান। বিশেষ করে জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা এবং ইতঃপূর্বে মাঠ প্রশাসনে কাজ করে সুনাম অর্জনের বিষয়গুলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করা হয়। শুধু কিছু প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পড়াশোনা করিয়েই একজন কর্মকর্তাকে এসব পদে দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করে ফেলা অসম্ভব। একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন দক্ষ প্রশাসক তৈরি হন যিনি রাষ্ট্র পরিচালনার সার্বিক আইনকানুন এবং বিধিবিধান সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা রাখেন।

বিতর্কিত এসএসপি আদেশ বাতিল হলেও এর দ্বারা যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, তার পরিণাম আমরা আজও ভোগ করছি। আমাদের আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরোধ পরিষদের নামে কয়েকটি ক্যাডারের নেতৃবৃন্দ উপসচিব পদ সব ক্যাডারের পদ হিসেবে যে দাবি জানিয়ে আন্দোলন করেছেন, তার প্রধান ভিত্তি এ বিতর্কিত এবং বাতিল হয়ে যাওয়া এসএসপি আদেশ। অন্যদিকে অন্যান্য ক্যাডারের পাঁচজন কর্মকর্তা ইতঃপূর্বে বাতিল হয়ে যাওয়া এসএসপি আদেশের আলোকে শতভাগ উপসচিব পদে সবার মধ্য থেকে পদোন্নতি প্রদানের দাবি করে ১৯৯৮ সালে সরকার কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০১০ সালে মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বেশ কিছু চমৎকার পর্যবেক্ষণ দিয়ে সরকার প্রণীত প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭৫% এবং অন্যদের জন্য ২৫% নীতিমালা বৈধ ঘোষণা করে মামলাটি নিষ্পত্তি করেন। আপিল বিভাগ তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন, ঐতিহাসিকভাবে সচিবালয়ের উপসচিব এবং ঊর্ধ্বতন পদগুলো প্রশাসন সার্ভিসের পদ। উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব মাঠ প্রশাসন এবং নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন বলেও আদালত তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে বর্তমানে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। এ বিষয়টি আরও গভীরভাবে ভেবে কাঠামোগত সংস্কারের রূপকল্প গড়তে হবে। না হলে জনপ্রশাসন থিতু হতে পারবে না। এমনকি নিয়োগের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা বাড়বে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা