গ্রিনল্যান্ড
নাথালি টোসিই
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৩৮ এএম
নাথালি টোসিই
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুরোনো অনেক ভাবনা গোটা ইউরোপকেও চমকে দিয়েছে। ইউরোপের কাছে ট্রাম্পের নানা ধরনের মন্তব্য অনেকাংশে, ‘কান দিয়ে ঢুকিয়ে বের করে দেওয়া’র মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের সঙ্গে ৪৫ মিনিট ফোনালাপের সময় তিনি হুমকি দেন। এ সময় তিনি আধাশাসিত দ্বীপটি যদি তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি না করেন তাহলে দেশটির টারিফ কমানোর হুমকি দেন। এ ঘটনার পরই দেশটি সামরিক খাতে ব্যয় বাড়তে শুরু করে। আর্কটিক অঞ্চলে দেশটি জাহাজ ও ড্রোনে খরচ বাড়ালেও তা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিমত্তার কাছে কিছুই না। অন্তত সেখানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক ঘাঁটির সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম।
ইউরোপিয়ান কোনো দেশ থেকে ইউরোপের বাইরের কোনো রাষ্ট্রের জমি দখলের হুমকির কথা মহাদেশটি ভালোই বোঝে। রাশিয়া নিয়মিত ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে হুমকি দিচ্ছে। আর এসব হুমকি ২০০৮ সালে বাস্তবায়িত হয় জর্জিয়া দখল এবং ২০১৪ সালে ইউক্রেন দখলের মাধ্যমে। কিন্তু এখন তাদের সবচেয়ে বড় মিত্রের কাছে এমন হুমকি পেয়ে মহাদেশটি বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। এতকিছুর পরও এ নিয়ে বড় প্রতিক্রিয়া আসেনি। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন দার লিয়েন এবং ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট অ্যান্টনিও কস্তা প্রকাশ্যে কিছুই বলেননি। এমনকি জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলৎজ বাধ্য হয়ে সামান্য কথা বলবে ভাবলেও তিনিও চুপ রয়েছেন। সংগতই প্রশ্ন হচ্ছে, হচ্ছে কী?
পরিস্থিতির এখনও একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। জনবায়ু সংকট এবং ভূ-রাজনীতির মেরুকরণে ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্যেই আর্কটিকের বরফ গলছে। গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আকর্ষণও সংগতই বাড়ছে। অন্যদিকে কোপেনহেগেনের সঙ্গে গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুকের সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠছে। গ্রিনল্যান্ড নিজস্ব স্বাধীনতার দাবি করছে। সম্প্রতি গ্রিনল্যান্ডের দুটো সংবাদমাধ্যম সার্মিস্টিয়াক ও ড্যানিস বার্লিংস্কে জানিয়েছে, ৮৫% গ্রিনল্যান্ডবাসী যুক্তরাষ্ট্রে যুক্ত হতে চায়। ডেনমার্কও শঙ্কিত। কারণ গ্রিনল্যান্ডের প্রতি তাদের দাবি অনেক জোরালো। আর এমনটি হলে দ্বীপটিকে আরও আলাদা করে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনেই নিয়ে যাওয়া ভালো। কোপেনহেগেনকে তার ইউরোপীয় মিত্ররা জানাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার সঙ্গেই লেনদেন করতে হবে।
এ বিষয়ে ইউরোপিয়ান নেতারাও অন্তরালেই থাকছেন। বিশেষত, জনসম্মুখে তারা নীরব থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে পেছনের দিকে অনকে কাজ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত তারা একত্রিত। ফ্রেডেরিকসন ইতোমধ্যে নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এমনকি জার্মানি, ফ্রান্স এবং ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুটের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং গ্রিনল্যান্ডের সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়ছে। জরুরি কাঁচামাল এবং শক্তি রপ্তানি বেড়েছে। অর্থাৎ গ্রিনল্যান্ড বিষয়ে ইউরোপের নীরবতা মানে তারা সতর্ক এবং ইচ্ছা করেই এমন করছে। মূলত ট্রান্স-আটলান্টিকের ওই আগ্রাসন থামাতেই কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিকভাবেই শঙ্কা এড়ানোর চেষ্টা বেশি চলবে।
তা ছাড়া এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ইউরোপ চিন্তিত। তারা চায়, ইউরোপের সামরিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন যেন অন্তত বরাদ্দ কমিয়ে না দেয় সেই নিশ্চয়তা। এমনকি ট্রাম্পের সঙ্গে তারা বাণিজ্যযুদ্ধও এড়াতে চাইবে। ইউরোপের নীরবতা তাই এখানে প্রয়োজনের নিরিখে। তারা চাইবে ইউক্রেনের বিষয়টি যেন বাড়তি গুরুত্ব পায়। তা ছাড়া ন্যাটোর সুতো হাতে ধরা ব্যক্তিকেও তারা হাতছাড়া করতে চায় না। উত্তর ও পূর্ব ইউরোপের অনেকেই ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্যুতিতে কষ্ট পাবে। আর এর মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্স-আটলান্টিক বাণিজ্যযুদ্ধ চলবে। এজন্যই তারা গ্রিনল্যান্ড নিয়ে বাড়তি কথা বলবে না। এ ক্ষেত্রে একটি জরুরি ব্যখ্যা জরুরি। একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকলেও নানা ঝুঁকি থাকে। কারণ নিষ্ক্রিয় থাকলে তা মূল্যস্ফীতির মতো বাড়তে থাকে। আর এমন নিষ্ক্রিয়তা ইউরোপের রাজনৈতিক সত্তাকে দাবিয়ে রাখতে পারে।
যুক্তি বাদ দিয়ে আমাদের বরং অনুভূতি দিয়ে অবস্থা বিচার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় আমাদের ধারণায় আসে। প্রথমত, ইউরোপের সবাই আতঙ্কিত। তারা ট্রাম্পকে ভয় পায়। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হতে তারা প্রস্তুত না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে, এমনকি তাদের রাজনৈতিক বয়ানকেও বন্ধ করে দিতে পারে। ট্রাম্প যতই তার হুমকিকে বাস্তব বলে অভিহিত করবে, তারা ততই এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে এড়িয়ে যাবে। ট্রাম্প ইউরোপের এই আতঙ্ক বুঝতে পারছে। যেন স্কুলের এক বুলি বুঝতে পেরেছে কাদের নিশানা করতে পারলে কাজ হবে। তারপরও ইউরোপের সবার মাঝেই অহেতুক দুশ্চিন্তা বাড়ছে। তারা আশা করছে, এই ঝড় পেরিয়ে যাবে। নীরবতার অনুবাদে হুমকি থেমে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। ইউরোপ এখন অ্যাড্রেনালিনের তাড়া হারিয়েছে।
অন্যদিকে আরেকটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। যুক্তি আর আতঙ্কÑএ দুটোর মিশেলে তারা সমস্যায় ভুগছে। কিন্তু সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এমনটি ভাবলে ভুল হবে। এমন সময়ে যুক্তিবৃত্তিক যে পরিবর্তন জরুরি তা এই মহাদেশে নেই। তা আসছে না। ট্রাম্প শাসন ক্ষমতায় বসেছেন বেশিদিন হয়নি। কিন্তু প্রথম সপ্তাহেই অনেক কিছু করে ফেলেছেন। যদি একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রকে হুমকি দেয় তাহলে ইউরোপের কি একত্রিত হওয়া জরুরি না? ইউরোপ যদি এ জটিল মুহূর্তে জাগতে না পারে তাহলে কখন জাগবে?
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ : আবেদিন আকাশ