× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পর্যবেক্ষণ

অর্থনীতি বিনির্মাণ করতে হবে নৈতিকতার ভিত্তিতে

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৯ এএম

ড. মিহির কুমার রায়

ড. মিহির কুমার রায়

অর্থনীতি ও নৈতিকতা। যার মধ্যে একটি নতুনত্ব আছে এবং উন্নয়নধর্মী আলোচনা অনেক সময় ধরে করা যায় তার বহুমুখী স্বরূপ নিয়ে; কিন্তু নৈতিকতা গবেষণার বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে দুরূহ ব্যাপার। কারণ, গবেষণার বিষয়ে বাস্তবে নৈতিকতার উপাদানগুলো শনাক্ত করে তা মূল বিষয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন জটিল প্রক্রিয়া। এখন প্রশ্ন আসে, নৈতিকতা বিষয়টি আসলে কী? সাধারণ অর্থে নৈতিকতা হচ্ছে মানুষের আচরণের সঠিক ও বেঠিক দিক; যা একজন মানুষ নৈতিকভাবেই তার কাজগুলো নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে পরিচালনা করবে। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে অর্থনীতির অসঙ্গতিগুলো অনেকাংশে কমবে এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সদা সত্য কথা বলিবেÑ নৈতিকতার একটি অঙ্গ। আবার কেউ কেউ বলেন, নৈতিকতা হলো মানবিকতার নীতি, যার ভিত্তি সৃষ্টি হয় পরিবার থেকে এবং পরবর্তী সময়ে স্বরূপ ঘটায় পরিবেশের আবর্তে; যা অনেকে নৈতিক অর্থনীতি বলে আখ্যায়িত করেন।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের মূল্য বাড়িয়ে দেয় যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্যক্তি সমাজের অংশ এবং সমাজ দেশের অংশ। এখন অর্থনীতির নৈতিক ভিত্তিগুলো সচল রাখার মাধ্যমে কীভাবে সমাজ তার মূল্য উন্নত করতে পারে নৈতিক অর্থনীতি আমাদের সে শিক্ষাই দেয়। আর মধ্যযুগীয় অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড় মার্শাল কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলেছেন, যার সঙ্গে নৈতিক অর্থনীতির সম্পর্ক রয়েছে। আবার অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথের ওয়েলথ অব ন্যাশনসের সঙ্গে সহমত পোষণ করে অনেকে অর্থনীতিবিদ যুক্তি দেখান, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা নৈতিক অর্থনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ; যা রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের ন্যায়বিচারের নৈতিক নিয়মকানুন পর্যবেক্ষণ করে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এ ধরনের একটি অপ্রচলিত চিন্তাভাবনা তাদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের বিষয় হিসেবে নির্ধারিত করল যার মধ্যে একটি বহুমাত্রিকতার উপস্থিতি বিদ্যমান; যেমন অর্থনীতি ও নৈতিকতা : জনকেন্দ্রিক উন্নয়ন, ভূমিগ্রাস প্রক্রিয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতি, নৈতিকতার প্রায়োগিক বিষয়াদি ইত্যাদি। এর একটা কারণ হতে পারে যে, বর্তমান সময়ে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে নৈতিকতা নামক কল্পিত বস্তুটির ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় এবং এ সম্মেলনের মাধ্যমে এ পুরোনো ধারণাটির আবার নতুন করে অনুশীলন করার একটা সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। বস্তুতপক্ষে সে কাজটিই হয়েছে এবং কর্মশালায় ১১৫টি গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ উপস্থাপিত হলেও যার মধ্যে গবেষণার বিষয়বস্তুর সঙ্গে নৈতিকতা সংযোগ করতে পেরেছে এ রকম প্রবন্ধ খুব কমই পরিলক্ষিত। তারপরও যে গবেষণাগুলোতে নৈতিকতার উপকরণটি কিছু হলেও স্থান করতে পেরেছে সেগুলো আবার আলোচনার বেড়াজালে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়ে ওঠেনি বিধায় কাজটি জটিল। তারপর প্রাপ্তির জায়গাটি হলো সবাই আলোচনা করে অন্তত এ ক্ষয়িষ্ণু সমাজে কিছুটা হলেও স্বস্তির জায়গাটা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। আলোচনায় আসে আমরা কেন নৈতিকতার উপাদানগুলো আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে অনুশীলনে সক্ষম বা সার্থক হতে বিরত থাকছি। আমাদের বস্তুকেন্দ্রিক সমাজে ভোগ এবং বিলাস যেখানে নিত্যদিনের সাথি যেখানে দর্শনভিত্তিক অভোগবাদী ব্যবস্থা আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলছে? আমরা কি জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি না?

সাধারণভাবে সমাজ যত বেশি জ্ঞানভিত্তিক দর্শন দ্বারা পরিচালিত হয় নৈতিক মূল্যবোধ তত বেশি শক্তিশালী হয়, মানুষের উদারতা বাড়ে এবং সামাজিক পুঁজির বিকাশ ঘটে যা অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে যেমন কৃষি, দারিদ্র্যমোচন, অসমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, শিল্প, গ্রামীণ সমাজ ইত্যাদি। এ বিষয়গুলোতে তাদের গবেষণার ক্ষেত্রের ব্যাপ্তি ঘটাবে নৈতিক বিষয়াদির নিরিখে এটাই স্বাভাবিক অর্থাৎ গবেষণা বা গবেষণা কার্যক্রম হলো একটি সৃষ্টিশীল কাজ। এ জায়গাটিতে আমাদের সংকট ঘনীভূত হয়ে আছে এবং এতে গবেষকের সংখ্যা কমছে আবার তার মধ্যে নৈতিকতার মানদণ্ডে উজ্জীবিত গবেষকের সংখ্যা একেবারেই হাতে গণনার মতো যা অর্থনীতি সমিতির তিন দিনের সম্মেলন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এর একটি প্রধান কারণ এ অস্থির সমাজে গবেষণার পরিবেশের স্বল্পতা তথা দায়বদ্ধতার মাত্রা সংকটাপন্ন যা আমাদের অর্থনীতি বা সমাজের একটি প্রতিচ্ছবি। একজন গবেষক হওয়ার পূর্বশর্তই হলো একজন ভালোমানুষ হওয়া বিশেষত নৈতিকতার ভিত্তি ধরে। তাই গবেষকদের হতে হয় নিরপেক্ষ একজন উত্তমপুরুষ এবং অধ্যয়ন তাদের নিত্যসঙ্গী। এরই পথ ধরে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছার সুযোগটি সৃষ্টি করবে। সম্মেলনের একজন প্রধান অতিথি বলেছেন, সমাজের সর্বস্তরে নৈতিকতার বিষয়গুলো গবেষণার আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং এর জন্য প্রয়োজন আদর্শিক গবেষক সৃষ্টি।

বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার একটি অপূর্ব ক্ষেত্র যেখানে শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা ফলাফল সম্প্রসারণ বিধিবদ্ধভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষকরা পাঠদান নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন আর পদোন্নতির সময় হলেই যতটুকু গবেষণা প্রকাশনার দরকার ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেন, যা অনৈতিক। আবার প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখা যায় অন্যের গবেষণা নিজের নামে ছাপিয়ে ডিগ্রি অর্জনের প্রবণতা; যা খুবই লজ্জাকর। শিক্ষকদের গবেষণা কাজে আকৃষ্ট করতে কিংবা গবেষণার জায়গাটি আরও অর্থবহ করে তুলতে গবেষকের ব্যক্তিগত আগ্রহ একটি বিষয় যার সঙ্গে যোগ হবে একটি সহায়ক পরিবেশ তথা সুযোগসুবিধা। এর প্রণোদনায় আছে আর্থিক বিষয় যার একটি ন্যূনতম সাপোর্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। আর যদি কোনো দাতা সংস্থা পাওয়া যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। গবেষণার জন্য আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হয় কিন্তু অর্থের বিনিময়ে গবেষক কেনা যায় না বা গবেষক বাজারের কেনাবেচার পণ্য নন। তাই নৈতিকতার বিষয়টি ধরে সুস্থ ধারার গবেষণা কিংবা গবেষক তৈরির কাজটা কি শুরু করা যায় না? যায় তবে নেতৃত্ব দেবে কে? অর্থনীতির খাতওয়ারি বিভাজনে সরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিদ্যমান যেমন শিল্প গবেষণার ক্ষেত্রে বিসিএস আইআর; কৃষি গবেষণায় ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সিস্টেম (নার্স), মৎস্য গবেষণায় বিএফআরআই, পশুসম্পদ গবেষণায় বিএলআরআই, পল্লী উন্নয়ন গবেষণায় বার্ড, অর্থনৈতিক গবেষণায় বিআইডিএম, ব্যবসা গবেষণায় ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ (বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়), চিকিৎসা গবেষণায় বিএসএমএমইউ আর সমাজবিজ্ঞান গবেষণায় অর্থ জোগানকারী প্রতিষ্ঠান সমাজবিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ। সেসব প্রতিষ্ঠানের গবেষণার অগ্রগতি, মান, ফলাফলের প্রয়োগ/সম্প্রসারণ ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েও গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। আবার গবেষণার বাজেটস্বল্পতা, স্বল্প বাজেটের অপ্রতুল ব্যবহার, ব্যবহৃত অর্থের হিসাব নিয়ে লুকোচুরি, বাজেট নিরীক্ষকদের কাছে অসম্মানিত হওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি কোনো গবেষকের জন্য সম্মানের বিষয় নয়; অথচ সেগুলো অহরহ ঘটছে। বিষয়গুলো সত্যিকার অর্থে অনৈতিক বিধায় নৈতিকতার মানদণ্ডে সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এমন এক সময়ে নৈতিকতা সম্পর্কিত তিন দিনের কর্মশালার আয়োজন করল যার ফলাফল তথা সুপারিশমালা আমাদের এ বিষয়ে আরও বাড়তি প্রায়োগিক ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছে যেমনÑ

এক. একজন আলোচক বলেছেন, আমাদের অর্থনীতির তাত্ত্বিক জ্ঞানের ভিত্তিতে আমরা যা জেনেছি বা বুঝেছি তা এখন আমার মনে হয় বাস্তবতার আলোকে এসব লেখা সনাতন। তাহলে আমাদের আবার নতুন করে ভাবতে হচ্ছে বাস্তবতা আর নৈতিকতা এ দুটি ইস্যু একীভূত করে বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ করা।

দুই. সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক অর্থনীতি একটি আর একটির পরিপূরক এবং নৈতিকতা সবটির মধ্যেই বিদ্যমান। এখন আমাদের গবেষণায় বা প্রবন্ধ রচনায় এ বিষয়টির উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত করা গবেষক বা প্রবন্ধকারের দায়িত্ব হলেও কাজটি সহজ নয়। তবে গবেষকমাত্রই নিরপেক্ষ নৈতিক মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যক্তি যিনি সত্য প্রতিষ্ঠিত করতেই সদা ব্যস্ত বিধায় তাকে কর্মের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়াই সরকারের বা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। সঙ্গে সঙ্গে স্বীকৃতি যা অনেক ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় না।

তিন. আমাদের সামাজিক জীবন যেসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সেগুলোতে নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিশেষত কাজগুলোর গুণগত মানের বিচারে; যা সমাজে প্রশংসিত হয় বারবার। সেসব কৃষ্টি ধরে রাখতে আমাদের চারপাশে যে পরিবেশ বিরাজ করছে তা বাজার অর্থনীতির রক্ষা কবচে আক্রান্ত এক সমাজ, যা কেবল লাভক্ষতির সাতকাহন খুঁজে বেড়ায়। তার অর্থ এটাই যে, নৈতিকতায় কি বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভব? অবশ্যই নয়, যা জ্ঞান মেধা দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, একজন মেধাবী জ্ঞানসম্মত মানুষমাত্রই সহানুভূতিশীল। নৈতিক অর্থনীতির দিকপাল পিটার কোসলোস্কি তার বিশ্লেষণে তিনটি মৌলিক উপাদান স্থান দিয়েছেন যথা অর্থনীতির নৈতিক পূর্বানুমান তত্ত্ব, নৈতিকতার অর্থনীতি ও দ্রব্যাদির অর্থনীতি, নৈতিকতা এবং সংস্কৃতির গুণগত মূল্য। এর বাস্তবায়নে প্রয়োজন গণসচেতনতা বৃদ্ধি, অর্থনীতির মানবিক বিষয়গুলো এবং নেতৃত্বের জবাবদিহির উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন স্তরে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা প্রতিহত করা। তাই আমাদের ক্ষয়িষ্ণু সমাজ মোকাবিলা করতে হবে এ অস্ত্রটি দিয়েই। আসুন আমরা সবাই মিলে অর্থনীতি বিনির্মাণ করি নৈতিকতার ভিত্তিতে, যেখানে গঠিত হবে এক নতুন সমাজ আর আমরা হব সে সমাজের কান্ডারি।

  • কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা