পরিপ্রেক্ষিত
আর কে চৌধুরী
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫০ এএম
রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে ঢাকায় আছিÑ স্বাধীনতার আগে রাজধানীবাসীর জন্য বাক্যটি প্রবাদ হয়ে উঠেছিল। কালের বিবর্তন মাছ, মিষ্টি, ফলমূলে রাসায়নিকের থাবা ঢাকা থেকে মাছির রাজত্বের অবসান ঘটিয়েছে। কিন্তু মশা তার দাপট বজায় রেখেছে অপ্রতিরোধ্যভাবে। ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষের এ মেগাসিটি মশার কাছে যেন জিম্মি। মশা নিধনে কর্তৃপক্ষের কর্মসূচির অভাব নেই। প্রতি বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে অঢেল টাকা ব্যয় করছে। তাতে কিছু লোকের পকেট স্ফীতি নিশ্চিত করলেও, মশার উপদ্রব কমছে না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে এডিস মশার আগ্রাসন। ডেঙ্গু নামের ভয়াবহ জ্বরের বিস্তার ঘটায় এই মশা। এডিস মশার আগ্রাসন থাকে বর্ষা মৌসুমে, কিন্তু এখন তা সাংবাৎসরিক মুসিবত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশের জনমনে। জ্বর হলেই চিকিৎসকরা পাঠাচ্ছেন পরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এ খাতে যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা ভিরমি খাওয়ার মতো। শুরুতে ডেঙ্গু ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক রোগ। মশা নিধনের পদক্ষেপ না নেওয়ায় তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের ১১টি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়নে মশা নিধন খাতে ব্যয় হয়েছে ৩৬০ কোটি ২৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এত টাকা ব্যয়ের পরও শুধু রাত নয়, দিনের বেলার স্বস্তিও নষ্ট করছে ক্ষুদ্র কীট মশা। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে রেকর্ডসংখ্যক ১ হাজার ৭০৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ৫৭০।
মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় তা যেমন বলতে গেলে কাজেই লাগছে না, তেমন মশা নিধনে যে ওষুধ ছিটানো হয় তাতেও শুভংকরের ফাঁকি থাকায় ট্যাক্সদাতাদের অর্থের শ্রাদ্ধ হলেও মশার হাত থেকে নগরবাসী রক্ষা পাচ্ছে না।
আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে দূর অতীতেও ঢাকায় মশার উপদ্রব ছিল। সে সময়ও মশা নিয়ন্ত্রণে নগর কর্তৃপক্ষ কাজ করেছে। সে কার্যক্রম এখন আরও জোরদার হয়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন মশা নিয়ন্ত্রণে বিপুল অর্থ খরচও হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো সুফল মিলছে না। আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে বাংলাদেশে মশাজাতীয় কীটপতঙ্গের উপদ্রব বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এসব কীটপতঙ্গের উপদ্রব অনেকাংশে বেড়েছে। তা নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের গবেষণা, কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান, প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, তার অনুপস্থিতি সংকট বাড়াচ্ছে।
ফেব্রুয়ারি-মার্চ সময়টা কিউলেক্স মশা প্রজননের সময়। মশা জন্মায় পুকুর, ডোবা, নর্দমায়। দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেক ডোবা ও নর্দমার উপস্থিতি থাকায় মশার উপদ্রব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ডোবা-নালা-নর্দমাগুলো পরিষ্কার না করায় মশার উপদ্রব বাড়ছে। মশা নিধনের জন্য যে ওষুধ কেনা হয় সেখানে চলে নানা ভাগবাঁটোয়ারা। এ অবাধ হরিলুট মশার দৌরাত্ম্য বাড়াতে অবদান রাখছে। তাইা মশা নিধনে নিতে হবে সমন্বিত পদক্ষেপ। একদিকে মশা নিধনের ওষুধ ছিটাতে হবে, অন্যদিকে ডোবা-নালা-জলাশয় পরিষ্কার রাখতে হবে। মশার হাত থেকে রেহাই পেতে হলে উভয় দায়িত্ব সমভাবে পালন করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের সততাও নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও ড্রেনগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না থাকা মশার বংশবিস্তারের অন্যতম কারণ। সঙ্গত কারণেই সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার এ বিষয়গুলো সামনে রেখে যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশে মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমেনি। বরং বেড়েছে কয়েক গুণ। এছাড়া ডেঙ্গুর ছড়াছড়ি চলছে দেশজুড়ে। প্রাণহানি ঘটছে এতে। ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি কোনোভাবই এড়ানোর সুযোগ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।
নগরী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে নাগরিকদেরও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মশা নিধনে শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন সব পক্ষের সচেতনতা। পরিচ্ছন্নতা, জনসচেতনতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আশঙ্কা সামনে রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মশার উপদ্রব রোধে সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক, এমনটি কাম্য।