× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পর্যবেক্ষণ

তারা আসলে কার সৈনিক

মহিউদ্দিন খান মোহন

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৪৫ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন

মহিউদ্দিন খান মোহন

দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ঘটল একই ঘটনা। গত ১০ জানুয়ারি শুক্রবার মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানায় যে ঘটনা ঘটেছিল, গত ২৪ জানুয়ারি রাজধানীর নিউমার্কেট থানায় ঘটেছে একই ঘটনা। পার্থক্য শ্রীনগরে দুর্বৃত্তরা থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল, নিউমার্কেট থানায় সেটা পারেনি। তবে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের মারধর করে আসামিকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কর্মীরা। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানায় এজাহারভুক্ত আসামি উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য থানায় আসেন শ্রীনগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেনদরবারে সফল না হওয়ায় সন্ধ্যা সাতটার দিকে তিনি চলে যান। নেতাকর্মীরা রয়ে যায় থানা প্রাঙ্গণে। এক পর্যায়ে তারা বাগবিতণ্ডায় জড়ায় ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে। রাত দশটার দিকে ‘জিয়ার সৈনিক, এক হও লড়াই কর’ স্লোগান দিয়ে তারা থানা ভবনে ঢুকে পড়ে। এরপর পুলিশ সদস্যদের মারধর করে থানাহাজত থেকে গ্রেপ্তার আসামি তরিকুলকে ছিনিয়ে নিয়ে বীরদর্পে চলে যায়। ঘটনাটি পরদিন সব জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ৩১ জন নামীয় আসামি ছাড়াও আরও ১৭০ জনকে অজ্ঞাত উল্লেখ করে একটি মামলা করেছে। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ৪ জন। যদিও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন। কেন্দ্রীয় যুবদল তরিকুলকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে।

অপরদিকে ঢাকার নিউমার্কেট থানার পুলিশ ইতঃপূর্বে এলিফ্যান্ট রোডে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহত করার মামলায় ২৩ জানুয়ারি ভোররাতে রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফুট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদ হোসেন মিথুন নামে এক ছাত্রদল নেতাকে। ২৪ জানুয়ারি সকালে গ্রেপ্তার মিথুনকে নিয়ে আসার সময় থানার গেটে ছাত্রদল কর্মীদের একটি গ্রুপ হামলা চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। হামলায় ডিএমপির সহকারী কমিশনার তারিক লতিফসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এই ঘটনার জেরে ওইদিনই ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহম্মদ হোসেন মিথুন ও সহ সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল হাসান রাসেলকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রদল।

ঘটনা দুটি পাশাপাশি দাঁড় করালে যে ছবিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটাকে ভয়ংকর বললে অত্যুক্তি হবে না। ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখে ভীত হওয়ার মতোই। এ ধরনের দুর্বৃত্তপনা আমরা দেখেছি পতিত আওয়ামী লীগের শাসনামলে। সে সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা ছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাদের ওপর কথা বলার সাহস কারও ছিল না। থানা-পুলিশ কিংবা সিভিল প্রশাসন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভয়ে তটস্থ থাকত অষ্টপ্রহর। ৫ আগস্ট (২০২৪) সেই দুর্বৃত্ত সরকারের পতন হওয়ার পর দেশবাসী হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। তারা কস্মিনকালেও ভাবেনি, লীগ-আমলের দুর্বৃত্তপনা আবার দেখতে হবে। কিন্তু ৬ আগস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত নানারকম সন্ত্রাসী ঘটনায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়টি জনমনে নতুন শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ‘তাহলে কি আমরা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়লাম?’ এটাকে কড়াই থেকে চুলায় পড়া বলে কি না জানি না। তবে এটা ঠিক, লক্ষণ মোটেই ভালো নয়। আওয়ামী লীগের পনেরো বছরের সন্ত্রাস ও ফ্যাসিবাদী শাসনের কবল থেকে মুক্ত বাংলাদেশের মানুষ পুনরায় সেই অরাজক অবস্থা ফিরে আসুক তা কখনই মেনে নেবে না। গত পাঁচ মাসে দলটি প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীকে নানা অপরাধে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু কর্মী-নেতাদের দুর্বৃত্তপনার লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। সংগত কারণেই জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছেÑ সরকারে না যেতেই যদি এরা এমন উপদ্রব করে, তাহলে সরকারে গেলে কী অবস্থা হবে? বিএনপির অনেক শুভানুধ্যায়ীকে বলতে শুনেছি, এদের কারণে দলকে আবার খেসরাত দিতে হতে পারে। 

নেতাকর্মীরা আদর্শে দীক্ষিত না হলে দল পরিণত হবে দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতকারীদের অভয়ারণ্যে। কেউ কেউ এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছেন, বিএনপির কর্মীদের কাজকর্মে যদি পতিত আওয়ামী লীগের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়, তাহলে গণঅভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লব, সবই অর্থহীন হয়ে যাবে

সবচেয়ে দুঃখজনক হলো এরা আবার নিজেদের ‘জিয়ার সৈনিক’ বলে পরিচয় দেয়। প্রশ্ন উঠেছে, হার্মাদের মতো আচরণকারী এরা কী ধরনের জিয়ার সৈনিক? বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান একজন সৎ, নীতিবান শাসক হিসেবে সমাদৃত। বিরুদ্ধবাদীরা তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেও ব্যক্তিগত কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আজ পর্যন্ত কেউ তুলতে পারেনি। অথচ ‘জিয়ার সৈনিক এক হও, লড়াই করো’ স্লোগান দিয়ে ওরা আসামি ছিনতাই করে নিয়ে যায় (শ্রীনগরে)! শুধু শ্রীনগর বা নিউমার্কেট থানার ওই দুটি ঘটনাই নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে সারা দেশে ‘জিয়ার সৈনিক’ নামধারী কতিপয় দুর্বৃত্ত যেসব ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে, তাতে দেশবাসী শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সেসব ঘটনার খবর জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে। গত ১৩ জানুয়ারি ‘প্রতিদিনের বাংলাদেশ’-এ তেমনি তিনটি খবর বেরিয়েছে। খবরগুলোর একটির শিরোনাম ‘বিএনপির নাম ভাঙিয়ে জমি দখলের অভিযোগ’। খবরটি এসেছে ভোলা জেলার চরফ্যাশন থেকে। খবরে বলা হয়েছে, হাজী মো. রুহুল আমিন নামে এক বৃদ্ধ সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন, তার প্রায় ৬ কোটি টাকা মূল্যের জমি প্রতিবেশী ফারুক মাস্টার ও তার দুই জামাতা মো. লোকমান হোসেন ও শিমুল মাস্টার দখল করার চেষ্টা করছে। তারা আগে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থাকলেও ৫ আগস্টের পর বিএনপির নাম ভাঙিয়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় খবরটি এসেছে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থেকে। তাতে জানা যায়, স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে ১১ জানুয়ারি রাতে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছে তিনজন। তৃতীয় খবরটি কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার। খবরে বলা হয়েছে, উপজেলা বিএনপির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন ইউনিয়ন বিএনপি নেতা নিহত হয়েছেন। আর ১২ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এক খবরে বলা হয়েছে, জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার আদারভিটা ইউনিয়ন বিএনপির নেতা মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান চৌধুরী মুক্তা ১১ জানুয়ারি এক দরিদ্র কৃষকের গরু চুরি করে এনে জবাই করে নারী সমাবেশে নেতাকর্মীদের ভূরিভোজ করিয়েছেন। ২৫ জানুয়ারির পত্রিকায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠেনের নেতাকর্মীদের সম্পর্কে যেসব খবর বেরিয়েছে সেগুলোর শিরোনাম তুলে ধরছি- ‘যুবদল নেতার বিরুদ্ধে সেলামি তোলার অভিযোগ’ (ঢাকার চকবাজারে), ‘যুবদল নেতার নামে চাঁদাবাজির মামলা’ (দুমকী, পটুয়াখালী), চাঁদা দিলে রক্ষা নইলে মামলা’ (বদলগাছি, নওগাঁ)।

উল্লিখিত খবরগুলো যে স্বস্তিদায়ক নয়, তা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। বরং এটা বলা অসংগত নয় যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন-পরবর্তী ক্ষমতাসীন হওয়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপির একশ্রেণির নেতাকর্মীর বল্গাহীন কাজকর্ম দলটি সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে। তবে এদের লাগাম টেনে ধরার যে চেষ্টা করা হচ্ছে না তা নয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রতিনিয়ত নেতাকর্মীদের সংযত থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ অন্যায় করলে ছাড় দেওয়া হবে না, সে হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন। তারপরও দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে দলটির নেতাকর্মীদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। 

প্রশ্ন হলো, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও বিএনপি নেতকর্মীরা সংযত হচ্ছে না কেন? এর একমাত্র কারণ এসব নেতাকর্মীর কোনো রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ নেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা-নেতার আদর্শ কী সেটাই ওরা জানে না। এর মুখস্থ আদর্শবাদী। আদর্শের কথা মুখে বলে, হৃদয়ে ধারণ করে না। বিএনপির একটি ‘প্রশিক্ষণ সেল’ রয়েছে, আছেন একজন প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদকও। গত মাসে সে প্রশিক্ষণ সেলের উদ্যোগে দেশব্যাপী ‘৩১ দফা রাষ্ট্র মেরামত কর্মসূচি’ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে কর্মীদের জন্য কর্মশালার আয়োজন হয়েছিল। কী প্রশিক্ষণ তারা কর্মীদের দিয়েছেন বলা মুশকিল। 

তবে নেতাকর্মীরা আদর্শে দীক্ষিত না হলে দল পরিণত হবে দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতকারীদের অভয়ারণ্যে। কেউ কেউ এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছেন, বিএনপির কর্মীদের কাজকর্মে যদি পতিত আওয়ামী লীগের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়, তাহলে গণঅভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লব, সবই অর্থহীন হয়ে যাবে।

  • সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা