সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৪৬ পিএম
আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৫১ পিএম
নাগরিক সেবা পদ্ধতি সহজিকরণ ও আধুনিকায়নের জন্যই প্রযুক্তি। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার নানা ফাঁদ পেতে আছে বিভিন্ন চক্র। এসব ফাঁদের জাল বেশিরভাগই ছড়িয়ে আছে সেবামূলক আর্থিক সংস্থাগুলোয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার ধরন যেমন বদলেছে, বেড়েছে মাত্রা এবং কৌশলও। ২৩ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ “বিলের টাকা ‘সিস্টেম’ করে সিস্টেম অ্যানালিস্ট চক্র” শিরোনামে প্রতিবেদনে তেমনই একটি চিত্র উঠে এসেছে। ঘটনাটি চট্টগ্রাম ওয়াসার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হতো বিলের টাকা। অনলাইন সিস্টেমে সেই বিল জমাও দেখানো হতো। তবে ওয়াসার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তা জমা না দিয়ে নিজেদের পকেটে পুরতো একটি চক্র। এভাবেই ২০১৯ সাল থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসার বিল ‘সিস্টেম’ করে যাচ্ছিল সিস্টেম অ্যানালিস্ট চক্রটি। বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার সিস্টেম অ্যানালিস্ট পদধারী ব্যক্তিই এ চক্রের হোতা। অভিযোগ আছে, অভিযোগটি চূড়ান্ত তদন্তের আগেই অপকর্মের হোতাদের রক্ষা করায় মাঠে নেমেছে একটি মহল। ধারণা করা হচ্ছে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ যাতে বের না হয়ে যায়, তার জন্যই মহলবিশেষের এ প্রচেষ্টা।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, প্রাথমিক তদন্তে এ অনিয়মের মাধ্যমে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে ওয়াসা। অনিয়মে জড়িত রাজস্ব শাখার দুই ডেটা এন্ট্রি অপারেটরকে পুলিশে দিয়েছে ওয়াসা। জানা যায়, ওয়াসার এমন কিছু বড় গ্রাহক আছেন, যাদের ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিল হয়ে থাকে। তারা এসব বিল নগদ অর্থে পরিশোধ করেন। আর সেসব অর্থই সংগ্রহের পর ওয়াসার কর্মীরা ব্যাংকে জমা না দিলেও গ্রাহককে কম্পিউটার সিস্টেমে বিল জমা দেওয়ার প্রমাণ দেখাতো এবং গ্রাহকরা মোবাইলে টাকা জমা দেওয়ার এসএমএসও পেতেন। যেহেতু প্রক্রিয়াটি প্রযুক্তিগত তাই গ্রাহকরা বিষয়টি স্বাভাবিকই ভাবতেন।
চট্টগ্রাম ওয়াসার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এটাই প্রথম নয়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ওয়াসার তৎকালীন এক এমডির নানা অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সেবার তদন্ত টিম ৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ে চলমান স্মার্ট মিটার প্রকল্পের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে অধিকতর তদন্তের জন্য। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতির আধুনিকায়ন করেছেন। যার ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে। জনসচেতনতা এবং বাস্তববুদ্ধি প্রয়োগ করে প্রযুক্তিনির্ভর এ প্রতারণা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
চট্টগ্রাম ওয়াসার এ ধরনের দুর্নীতি-অনিয়ম অনেক পুরোনো অধ্যায়। এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও নানা অনিয়ম ছেয়ে আছে। শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম নিয়মে পরিণত করে লাভবান হচ্ছে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নগরবাসী। নানা সময়ে সংস্থাটিতে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার, সেহেতু এমন দুর্নীতিবাজ ও বেপরোয়া ব্যক্তিকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। তা ছাড়া নানা সময়ে সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্তদের চুরি, অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে সরকার যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং হচ্ছে; তারও তদন্ত করে তা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সেজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে যথাযথ তদারকি বাড়াতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, চট্টগ্রাম ওয়াসা একটি সেবামূলক সংস্থা। রাজধানী ঢাকার পর জনসংখ্যার আধিক্যে চট্টগ্রাম ওয়াসাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। নগরবাসীর জন্য টেকসই উপায়ে সারা বছর বিশুদ্ধ পানির জোগান নিশ্চিত করা এবং মহানগরকে পয়োনিষ্কাশন সেবার আওতায় আনার দিকে নজর দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো, বৈদেশিক ঋণনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অপচয় ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। এ ধরনের গ্রাহক প্রতারণা বন্ধ করা হোক। পানি জীবনের অপরিহার্য উপাদান, ফলে পানিকে আর দশটা বাণিজ্যিক পণ্যের মতো বিবেচনা করা যাবে না। সিস্টেম অ্যানালিস্টের নেত্বত্বে চক্রটি নগরবাসীকে ন্যূনতম সেবা না দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আদায়ের যে পন্থা অবলম্বনের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তা কেবল জনগণই নয়, রাষ্ট্রের সঙ্গেও প্রতারণা। এটা চাকরির শর্তবিধিরও লঙ্ঘন। তাই এ দুর্নীতিবাজদের দ্রুত বিচার না হলে জনমনে প্রশ্ন দেখা দেবে। অনিয়ম-দুর্নীতি অনুসন্ধানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে লাভজনক ও নাগরিকবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশা।