× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কিশোর গ্যাং

ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের

এলিনা খান

প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৩৪ পিএম

ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের

সারা দেশে সম্প্রতি অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। একের পর এক সামনে আসছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানাবিধ অপরাধের ঘটনা। যা শহরাঞ্চলের জননিরাপত্তায় তো বটেই গ্রামেও বড় ধরনের অভিঘাত ফেলছে। সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়তই এই যে নানাবিধ অপরাধের খবরÑ তার একটি বড় অংশের সঙ্গে ‘কিশোর গ্যাং’-এর নাম আসছে। অথচ একসময় এ ধরনের অপরাধের পেছনে স্থানীয় বা আঞ্চলিক কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর নাম শোনা যেত। সেই স্থানটিই এখন ‘দখল’ করেছে কথিত কিশোর গ্যাং। যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৮ বছরের কম। তাদের নানাবিধ অপকাণ্ডে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে, আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, অপরাধও বাড়ছে। এ ধরনের অপতৎপরতা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা বাড়ার শঙ্কা থাকে। যা সামাজিক স্থিতিশীলতাও নষ্ট করে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হয়। এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা কমাতে পারিবারিক উদ্যোগের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যদি দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো যায় তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশেই দমন করা সম্ভব। সমাজে অপরাধপ্রবণতার হার কমাতে সরকারকে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেই এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ের মাধ্যমে কৌশলী হওয়া জরুরি। পাশাপাশি মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক যে বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে তাদেরও অবদান রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে সমন্বয়ও এ ক্ষেত্রে কাজ অনেক সহজ করে দিতে পারে।

দেশে অপরাধপ্রবণতা যে পর্যায়ে রয়েছে তা আগে চিহ্নিত করতে হবে। বিগত রাজনৈতিক সরকারের সময়েও আমরা দেখেছি, রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। তাদের বেপরোয়া হয়ে ওঠা। দেশে কিশোর অপরাধ আগেও ছিল। তবে প্রায় অর্ধ যুগে কিশোর অপরাধের যে মাত্রাতিরিক্ত হিংস্রতা তা আগে দেখা যায়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। অপরাধগুলো ক্রমেই নৃশংস হয়ে উঠেছে। সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্য দিনের আলোয় মানুষ হত্যা করার মতো জঘন্যতারও কু-নজির তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই অন্ধকার থেকে রক্ষা জরুরি। কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব একসময় শুধু রাজধানীতেই ছিল। কিন্তু ক্রমশ তাদের অস্তিত্ব দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। যা আমাদের জননিরাপত্তার জন্যও একটি বড় সংকট হিসেবে আজ আবির্ভূত। কিশোর গ্যাং এখনও রয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ছিনতাই, রাহাজানি, নারী সহিংসতাÑ এমনকি মাদক চোরাচালানের কাজেও তারা যুক্ত।

কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য মানেই সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বা পিছিয়ে পড়া অংশের পরিবারের সন্তানÑ এমনটি ভাবলে ভুল হবে। বরং বিগত রাজনৈতিক সরকারের আমলে কিশোর গ্যাংয়ের যাদের অস্তিত্ব প্রকট হয়ে উঠেছিল, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত ছিল না, যারা হত্যাসহ নানাবিধ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হয় তাদের বড় অংশই সমাজের অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান। আবার অনেকে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে কিশোর গ্যাং তৈরি করে অন্তরালে থাকত। কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতেন এমন অভিযোগও রয়েছে। 

আমাদের মনে রাখতে হবে, কিশোর ছেলেমেয়েরা খুব সহজে প্রভাবিত হয়। বুঝতে ও জানতে শেখার এই সময়েই যদি তাদের মধ্যে ‘ক্ষমতা’র বিষয়টি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তবে তাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই সহিংসতাই প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে। প্রযুক্তির অগ্রসরায় আমাদের কিশোররা খুব দ্রুত উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। বিশ্বকে তারা হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছে। ভিনদেশি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আবার সেই সংস্কৃতিকেই তারা ধারণেরও চেষ্টা করছে। ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা যেমন দেখা যাচ্ছে, তারই প্রভাব দেখা যাচ্ছে তাদের আচরণগত পরিবর্তনের মধ্যেও। যার কু-প্রভাব পড়ছে সমাজে এবং কিশোর অপরাধ বাড়ছে।

কিশোর গ্যাং নিয়ে গত কয়েক বছরে কথাবার্তা হয়েছে অনেক। কিন্তু তাদের পুনর্বাসন বা আর কোনো কিশোর যেন বিপথে না যায় সেজন্য যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তার যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে কিশোরদের মাঝে অপরাধপ্রবণতা কমানো যায়নি। যখন কোনো কিশোর মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো অপরাধে অভিযুক্ত হলেও আদালত সর্বোচ্চ শাস্তি তাদের দেন না। অথচ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, ছিনতাই, ধর্ষক ও মাদক চোরাচালানের মতো ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের অপরাধ কমাতে আইনি ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এখন সময়ের দাবি। যদি তা না করা যায়, তাহলে কিশোর গ্যাং সামনে ভয়াবহ একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে গড়ে উঠবে। 

লক্ষণীয়, কিশোরদের জন্য আদালত থাকলেও সে আদালতের অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। অথচ এ ধরনের বিশেষায়িত আদালত কিশোরদের পুনর্বাসনেরও দায়িত্ব পালন করে থাকে। সিনিয়র আদালতই অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোর আদালতে রূপান্তরিত হয়। এ ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা হলো, কিশোরদের যখন আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়, তখন তাদের দাগি আসামিদের সঙ্গেই ঠাঁই পেতে হয়। ফলে যখন তারা পুনর্বাসনের জন্য সাজা পায়, তখনও এই আসামিদের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাতে পুনর্বাসনের বদলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিপ্সা তাদের বেড়ে যেতে পারে। এজন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে কোর্ট অবকাঠামোর প্রসার ঘটাতে হবে। এই স্তম্ভে অতীতেও বলেছি, পারিবারিক ও শিশু নির্যাতন আইনের আদালতের এজলাসের বড় সংস্কার জরুরি। রাজধানীর আদালতগুলোর ভয়াবহ চিত্র দেখলে যে কেউই আতঙ্কিত হতে বাধ্য। এখানে বাদী, বিবাদী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অনেকেই একধরনের নির্যাতনের শিকার হয় উপযুক্ত অবকাঠামোর অভাব থাকায়। অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের জন্য একটি দুর্ভোগ। আর সাক্ষীরাও যেহেতু স্বস্তির পরিবেশ পায় না তাই তারা সদিচ্ছা রাখলেও সচরাচর আদালতে আসতে রাজি হয় না। এমনটি মোটেও ইতিবাচক নয়।

সামাজিক অস্থিরতা আর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে যাওয়ায় অন্যসব অপরাধের সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতনের হারও বেড়েছে। আমরা দেখছি, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের মামলার একটি বড় অংশই পুলিশ বা আদালত পর্যন্ত যায় না। লজ্জা, সম্মানহানি এবং কখনও কখনও পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি অনীহা এবং প্রতিপক্ষের ভয়েও নির্যাতিতদের একটি বড় অংশ অভিযোগ করে না। এ কারণে প্রকৃত অপরাধ বা ঘটনার চাইতে মামলার সংখ্যা কম হয়। ফলে মামলার সংখ্যা বা পত্রিকার সংবাদ দেখে সঠিক পরিসংখ্যান বের করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে বা এ ধরনের অপরাধ রোধে আইন প্রয়োগে আরও বেশি কঠোরতা দেখাতে হবে। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত, মেডিকেল পরীক্ষা এবং আদালতে বিচারকাজে দীর্ঘ সময় নেওয়া ও ভিকটিমের জেরার জটিলতাও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এইসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কমাতে পুনর্বাসনের বিষয়টিকে জোর দিতে হবে।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তরুণদের যে প্রাণোচ্ছলতা দেখা গেছে তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। আবার এই তরুণদের একটি অংশ বিভিন্ন মহলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোররা অনেক ক্ষেত্রেই পরিণতি বাছবিচার না করে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। এ ধরনের অপরাধে যুক্ত হতে অনেক সময়েই তারা নানাভাবে রাজনৈতিক গোষ্ঠী দ্বারা ব্যবহৃত হয়। আর একবার এ পথে নিমজ্জিত হলে তারা সহজে বের হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে কিশোরদের পুনর্বাসনের বিষয়টিকে জোর দিতে হবে। তরুণ ও যুবসমাজের উন্নয়নে সামাজিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দক্ষতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আটক করলেই হবে না। তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে আবার সমাজে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজ তাদের সঙ্গে সহনশীল আচরণ করলে তারা অন্ধকারের পথে পা দিতে পারে না। এ বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যেও সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য তাদের সঠিকভাবে পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। সেইসঙ্গে কিশোরদের ব্যবহারের মাধ্যমে যারা ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চান তাদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। যদি তা না করা যায়, তাহলে এ সমস্যাটি ভয়াবহ রূপ নেবে। 

  • আইনজীবী ও চেয়ারপারসন, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা