× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

মুক্তির লড়াই আজও চলছে

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৩৩ পিএম

মুক্তির লড়াই আজও চলছে

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পরপরই ধর্মীয় জাতীয়তার বিপরীতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার উন্মেষ ঘটেছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেই। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূতিকাগার বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত দিনটি। একইভাবে স্বাধিকার-স্বাধীনতার অভিমুখে অগ্রযাত্রায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান দিবস ২৪ জানুয়ারি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের যুগান্তকারী একটি দিন। ঊনসত্তরের পটভূমি তৈরি হয়েছিল দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্বাধীনতার সোপান। বলা যায়, ঊনসত্তরই নির্ধারণ করে দিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের অভিযাত্রা।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতিগত শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি ক্রমাগত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে আইয়ুব, মোনায়েম গং কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান অভিযুক্ত করা হয়। মামলাটি যে রাজনৈতিক মতলব হাসিলে শেখ মুজিবকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র ছিল, এটি সর্বস্তরের মানুষের কাছে তখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এ মামলার অভিযুক্ত বেশিরভাগই ছিলেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বাঙালি সদস্য। জাতিগত বৈষম্যের শিকার বিক্ষুব্ধ বাঙালি সামরিক সদস্যরা সংগঠিত হয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু অভ্যুত্থান ঘটানোর আগেই তথ্য ফাঁস হওয়ার কারণে সামরিক গোয়েন্দারা দ্রুত অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে তাদের আটক করে। দায়েরকৃত মামলায় শেখ মুজিবকে প্রধান অভিযুক্ত করার ফলে মামলাটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। অথচ ব্যর্থ হওয়া সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন মামলার দ্বিতীয় অভিযুক্ত নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। তার নেতৃত্বেই সামরিক সদস্যরা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে তাই প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল গণহত্যার শুরুতে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরে বর্বর পাকিস্তানি সেনারা এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিচার চলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সামরিক আদালতে। অভিযুক্তদের বিচারিক কার্যক্রমের সময় সাংবাদিক আতাউস সামাদের মাধ্যমে শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীকে মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তি দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেন। ওই চিঠি প্রাপ্তির পরই মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবসহ অভিযুক্তদের মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেন। ধর্মঘট, হরতাল, সমাবেশ সংঘটনে বিক্ষুব্ধ দেশবাসী সাড়া দেওয়ার ফলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। অচল হয়ে পড়ে পাকিস্তানিদের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব। অভ্যুত্থানের তীব্রতর পরিস্থিতি সামাল দিতে আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে মামলা প্রত্যাহারে এবং অভিযুক্তদের মুক্তি দিয়েও নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আইয়ুব খানের ওপর সমর্থন প্রত্যাহারের ফলে আইয়ুবকে সরে যেতে হয়। একই ঘটনা ঘটেছে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এবং সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থানে। আইয়ুবের বিদায় এবং তার স্থলে সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার আগমন ঘটে। আন্দোলন দমনে কৌশল অবলম্বনে নির্বাচনের মুলোর আকর্ষণে জাতীয় নেতৃত্ব কর্তৃক পরিসমাপ্তি ঘটে একটি সম্ভাবনাময় অভ্যুত্থানের পরিণতি। অথচ এ অভ্যুত্থানেই আমাদের বিজয় অর্জনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি হরতালের দিন ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে আসাদ শহীদ হওয়ার পর আন্দোলনের গতি স্ফুলিঙ্গের মতো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেখ কাদেরের নেতৃত্বে আমরা আজিমপুর এলাকায় মিছিল বের করি। আজিমপুর শাহসাহেব বাড়ি বটতলার পাশে আসাদদের পারিবারিক বাসায় মিছিল নিয়ে পৌঁছাই। বাসার দোতলা থেকে আমাদের উদ্দেশে আসাদের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নামিয়ে দেয় তার পরিবারের লোকেরা। এতে দ্রুত মিছিলটি তীব্র আকার ধারণ করে। একপর্যায়ে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত মিছিলটি আরও বেগবান হয়ে ওঠে। আমরা মিছিল নিয়ে এলাকা প্রদক্ষিণ করে নীলক্ষেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে পুলিশের গাড়ি এসে লাঠিচার্জ করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

উত্তাল ঊনসত্তরে স্কুলছাত্র আমি স্কুল থেকে বের হওয়া মিছিলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশে যোগ দিয়েছি। মিছিলে মহিউদ্দিন ইউসুফ মন্টু ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু চাচা আমাকে দেখে নিরাপত্তার স্বার্থে পুরানা পল্টন লেনে দাদির হেফাজতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে পারিবারিকভাবেই এক প্রকার গৃহবন্দি হই। ২৪ জানুয়ারি হরতালের দিন পল্টনে মিছিল, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের তীব্র শব্দ আমাকে উত্তেজিত করে। কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যোগ দিই প্রেস ক্লাবের দিক থেকে মতিঝিলের পুবদিকের সড়ক অভিমুখে যাওয়া মিছিলের স্রোতে। ইতোমধ্যে পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউরের নিহত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। মিছিলটি দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মোড়ে যাওয়া মাত্র বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ পত্রিকার কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পত্রিকার কার্যালয়ের বিপরীতের মুসলিম লীগার লস্করের পেট্রলপাম্পটিতেও আগুন দেওয়া হয়। চারদিকে আগুনের লেলিহান। যে যেদিকে পারে নিরাপদ স্থানের খোঁজে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে, এমন সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাস এবং বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। টিয়ার গ্যাসের তীব্র ধোঁয়া আর পুলিশের লাঠির আঘাত খেয়ে বহুকষ্টে দাদার বাড়ি ফিরে আসি।

তিরস্কারের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়াই দাদির সামনে। আমার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আমাকে গোসল করার আদেশ দেন। চোখে প্রচণ্ড জ্বালা-যন্ত্রণায় গোসলে কিছুটা স্বস্তি বোধ করি। নতমুখে পুনরায় দাদির সামনে দাঁড়াই। দাদির চোখের দিকে তাকানোর শক্তি ও সাহস কোনোটাই তখন ছিল না। দাদি বলেন, ‘তোমার কিছু হলে তোমার বাবা-মাকে কী জবাব দিতাম? তুমি আজ যা করেছো তা কি সঠিক বলে মনে করো?’ আমি নতমুখে বলি, ‘না’। তিনি বলেন, ‘এটা যদি বুঝে থাকো তবে ভবিষ্যতে নিশ্চয় এমনটি আর করবে না?’ আমাকে তখন ঘুমানোর উপদেশ দিয়ে বললেন, ‘তুমি তো ফিরছো। আরেকজন কি ফিরবে, না লাশ হয়ে ফিরবে, জানি না।’ তার আশঙ্কার উদ্দেশ্য ছিল নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু চাচা।

২৪ জানুয়ারি প্রতি বছর ঘুরেফিরে আসে। আজও জ্বলজ্বল করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি। যে অভ্যুত্থানে আমাদের মুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। সে সম্ভাবনাটি নির্বাচন অভিমুখে ঠেলে দিয়ে অভ্যুত্থান উদ্দেশ্যমূলক বানচাল করা হয়েছিল। একাত্তরের গণহত্যা আমাদের পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমরা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে বিজয় অর্জন করলেও; সে বিজয় সমষ্টিগত মানুষের বিজয়ে পরিণত না হওয়ার কারণে মুক্তির লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তির লড়াই আজও চলছে এবং চলবে অবিরাম, সমষ্টিগত মানুষের অধিকার ও মুক্তি না হওয়া অবধি।

  • নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা