বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত
মীর আব্দুল আলীম
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৪৯ এএম
মীর আব্দুল আলীম
বিশ্বজুড়ে যে অস্থিরতার পটভূমি তৈরি হচ্ছে, তার প্রভাব কেবল একটি দেশের ভৌগোলিক সীমায়ই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বিশ্ব নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন ক্রমশ হুমকির মুখে ফেলছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক অস্থিরতা সে চিত্রেরই প্রতিফলন। সীমান্তে বারবার যুদ্ধের জিগির, উস্কানিমূলক কার্যকলাপ, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া নিয়ে বিতর্কÑ সবই দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যুদ্ধ বা সংঘাত কোনোভাবেই এ উত্তেজনা নিরসনের সমাধান হতে পারে না। আমরা মনে করি, শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সংকট মোকাবিলা করাই সঠিক পথ। ইতিহাস বলছে, যুদ্ধ-সংঘাত কেবল ধ্বংস, ক্ষয়ক্ষতি এবং মানুষের দুর্ভোগ ছাড়া কিছুই বয়ে আনে না। যেকোনো যুদ্ধের পরিণতি হয় বহু মানুষের প্রাণহানি, সম্পদের অপচয় এবং দীর্ঘমেয়াদি বৈরিতা। যুদ্ধ মানে দুই পক্ষেরই নাগরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি। যুদ্ধের জন্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ এবং সামরিক প্রস্তুতির পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো উন্নয়নÑ এসব গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমিয়ে যুদ্ধের পেছনে অর্থ ব্যয় করলে সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সীমান্ত নিয়ে এ মুহূর্তে দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজমান, তা নিরসনে ধৈর্য ও কূটনৈতিক সংলাপ তথা বৈঠকই একমাত্র সমাধান। এ ধরনের বৈঠক শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে আরও নিয়মিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। যাতে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে। সীমান্তে দায়িত্ব পালনকারী দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি ও বিএসএফের ওপরই নির্ভর করে পরিস্থিতি শান্ত রাখা। তাদের অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করে সীমান্তে কাজ করতে হবে। আমরা মনে করি, সীমান্তে অনভিপ্রেত কোনো ঘটনার উদ্ভব হলে তা শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবিলার জন্য আরও দায়িত্ববান হতে হবে। উভয় পক্ষের একটি ভুল পদক্ষেপও সংঘাতের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। সীমান্তে উস্কানিমূলক কার্যকলাপ যেমন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম, বাংকার তৈরি বা কাঁটাতারের বেড়া দিতে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। এসব এড়াতে কূটনৈতিক স্তরে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে উভয় সীমান্তের সাধারণ মানুষও উস্কানিমূলক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। ভুল তথ্য, গুজব ও আবেগপ্রবণ আচরণ দ্বন্দ্ব বাড়াতে পারে।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার হয় সাধারণ মানুষ। প্রাণহানি, উদ্বাস্তু সমস্যা, খাদ্য ও পানীয় সংকট এগুলো যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। যুদ্ধের জন্য যে অর্থ ব্যয় হয়, তা দেশের উন্নয়নমূলক কাজ থেকে সরিয়ে নেয়। এটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেয়। যুদ্ধ কেবল শত্রুতা বাড়ায় এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কোন্নয়নের পথ বন্ধ করে দেয়। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে তা আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে দুই দেশই কূটনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
কূটনৈতিক আলোচনা জোরদার করে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সরাসরি আলোচনার পথ খুলে দেওয়া উচিত। দুই দেশের জনগণ একে অন্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হলে সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে। সীমান্ত এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত জনগণের জীবনমান উন্নত করতে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া উচিত। গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। গণমাধ্যমকে উস্কানিমূলক সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকতে হবে। সংবেদনশীল ইস্যুতে সতর্কভাবে প্রতিবেদন তৈরি করা প্রয়োজন। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক দীর্ঘকাল ধরে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গভীরভাবে সংযুক্ত। সুতরাং কূটনৈতিক সংলাপও সহজতর হওয়ার কথা। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কিছু পরামর্শÑষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো শক্তিশালী ও সুপরিকল্পিত কূটনীতি। বাংলাদেশ এবং ভারতের উভয়ের উচিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধান করা। নিয়মিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আয়োজন করা। সীমান্তসংক্রান্ত ইস্যুতে স্বচ্ছতা বজায় রাখা। ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে যৌথভাবে প্রতিবাদ করা।
মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত বিভ্রান্তিমূলক তথ্য মোকাবিলার জন্য উভয় দেশের সরকারকে কাজ করতে হবে। সরকারি প্রচারমাধ্যম থেকে সঠিক তথ্য প্রচার। উস্কানিমূলক সংবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক করা। যদি কোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থেকে থাকে, তবে তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা প্রয়োজন। জাতিসংঘ, ওআইসি, সার্কের মতো সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খোঁজা। যেকোনো ষড়যন্ত্রের পেছনে থাকা পক্ষকে প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা করা। সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। সীমান্তে যৌথ টহল পরিচালনা। সন্দেহমূলক কার্যকলাপের ওপর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জনগণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে উস্কানিমূলক খবর থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া। দেশপ্রেম ও সংহতির চেতনা জাগ্রত করা।
একটি দেশ কখনই বিচ্ছিন্নভাবে উন্নত হতে পারে না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে উত্তেজনা থাকলে তার প্রভাব নিজ দেশেও পড়ে। তাই দুই দেশকেই বুঝতে হবে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তাদের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। যুদ্ধ বা উত্তেজনা কখনই কোনো দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। ভারত এবং বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সমস্যা থাকতেই পারে, তবে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করাই একমাত্র উপায়। যদি কোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থেকে থাকে, তবে তা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রতিহত করা সম্ভব। শান্তি এবং সমঝোতার পথেই এ অঞ্চলের জনগণের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সম্ভব।
যুদ্ধ কখনই সমস্যার সমাধান নয়, বরং শান্তি এবং সংলাপই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ। মালদার মহদীপুর সীমান্তে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। যুদ্ধের পথে না গিয়ে দুই দেশ যদি কূটনৈতিক সমাধানে এগোয়, তবে উভয়েরই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। আসুন আমরা সবাই মিলে যুদ্ধের পথ পরিহার করে শান্তির পথে হাঁটি। শান্তি হোক আমাদের লক্ষ্য আর একতার বন্ধন হোক আমাদের শক্তি।