সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৪ এএম
‘সময়মতো মজুরি পান না ৮০ শতাংশ শ্রমিক’Ñ শিরোনামে ১৩ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি উদ্বেগজনক। সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ শ্রমিকই মাসের শুরুতে মজুরি পান না। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে কম বেতন পাওয়া ও সময়মতো পদোন্নতি না পাওয়ারও। বিভিন্ন সময়ে দেশের নানা স্থানে দেখা দেওয়া শ্রমিক অসন্তোষের পেছনেও এসব কারণই অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে বলেও গবেষণায় দাবি করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
যথাসময়ে মজুরি না পাওয়ার সঙ্গে আরও উদ্বেগজনক একটি বার্তাও উঠে এসেছে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, দেশের ৮৫ ভাগ বা প্রায় ছয় কোটি শ্রমিকের কোনো আইনি সুরক্ষা ও মজুরির মানদণ্ড নেই। রাজধানীতে ‘শ্রমিকের জীবনমান, কর্মপরিবেশ ও অধিকার সংক্রান্ত সংস্কার উদ্যোগ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য প্রস্তাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় শ্রম খাতের জন্য একটি অভিন্ন মজুরি কাঠামো প্রণয়নের সুপারিশের কথা উঠে এসেছে। আমরাও মনে করি অভিন্ন মজুরি কাঠামো প্রণয়নের মাধ্যমে শ্রম খাতে শ্রমিকের শ্রম নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হতে পারে তেমনি তাদের কর্মপরিবেশ ও অধিকারের বিষয়গুলোও তাতে করে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে।
আমাদের স্মরণে আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এপ্রিল ২০২২ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী, বার্তাবাহক, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ কর্মচারীদের প্রারম্ভিক বেতন-ভাতা সর্বনিম্ন ২৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছিল। ওই নির্দেশনা এ-কথাই প্রমাণ করে যে মাসে ২৪ হাজার টাকার কম মজুরিতে ন্যূনতম মানসম্পন্ন জীবনযাপনের সুযোগ নেই। এর আগে ২ জুলাই ২০১৮ তারিখে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার শ্রমিকের যে মজুরি অনুমোদিত হয় তাতে ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর মজুরির মূল বেতন ৮,৩০০ টাকা, যা প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করার নিয়ম কার্যকর আছে। এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মূল বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা-ভাতা, টিফিন-ভাতা, যাতায়াত-ভাতা, ধোলাই-ভাতা, ঝুঁকি-ভাতা, শিক্ষা সহায়তা-ভাতা যুক্ত করলে বর্তমান মজুরি হয় প্রায় ২৪ হাজার টাকা। আমরা মনে করি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন কাঠামোকে জাতীয় মানদণ্ড ধরা উচিত।
অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক গতিশীলতা বাড়ে। মানসম্পন্ন মজুরি যেমন শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করে। আমরা যদি দেশকে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করতে চাই তাহলে শ্রমজীবী মানুষের আয় যেমন বাড়াতে হবে তেমনি তাদের ন্যায্য মজুরিও নির্ধারণ করতে হবে এবং তা যথাসময়ে পরিশোধ করতে হবে। আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ানোর যে লক্ষ্য শিল্প খাতের মালিকসহ সরকারের তরফ থেকে প্রত্যাশা করা হয়, সেই স্বপ্নের সঙ্গে শ্রমিকরাও সম্পৃক্ত। তাই যথাসময়ে শ্রমিকদের মানসম্পন্ন জীবনযাপনের উপযোগী মজুরি নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে উঠবে।
আমরা আশা করি, সরকার ও মালিকপক্ষের আন্তরিকতায় শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে। শ্রমিকদের ঠকিয়ে শিল্পের বিকাশ বা বাড়তি মুনাফা করা যায় না। শ্রমিক বাঁচলেই কেবল শিল্প বাঁচবে। আর শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এই মনোভাব নিয়ে সরকার ও শিল্পমালিকেরা কাজ করলে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। এজন্য আমরা দেশের অর্থনীতির সুষম বিকাশের স্বার্থে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাপনের ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা জরুরি। সেইসঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে যেসব শ্রমিক কাজ করছেন, তাদের সবার চাকরির নিরাপত্তার দিকটিও নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের ১৪১ ধারায় বলা আছে জীবনযাপন ব্যয়, জীবনযাপনের মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মান, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, দেশের ও সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
শ্রম আইনে উল্লিখিত মানদণ্ডসমূহ বিশ্লেষণ করে শ্র্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের জন্য যেমন বলি, তেমনি তাদের প্রাপ্য মজুরি যথাসময়ে পরিশোধের জন্যও বলি। শ্রমিকের আয় না বাড়লে তাদের জীবনমান বাড়বে না। শ্রমিকরা মানসম্পন্ন জীবনযাপন করার মতো যদি মজুরি না পান, তা যেমন মেনে নেওয়া যায় না, তেমনি সময়মতো সেই মজুরি না পাওয়ার বিষয়টিও মেনে নেওয়া যায় না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের সঙ্গে শ্রম খাতের সংস্কারেও কমিশন গঠন করেছে। আমাদের প্রত্যাশা শ্রম কমিশন এ খাতে সংস্কারের সুপারিশ করার পর তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের বিষয়টিও কীভাবে নিশ্চিত করা যায় তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাও দেবে।