পরিবেশ
ড. মো. জিল্লুর রহমান
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫০ এএম
ড. মো. জিল্লুর রহমান
দেশে নদ-নদী ও জলাশয় রক্ষার বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। গোটা বিশ্বেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ অভিঘাত লাগতে শুরু করেছে। এমন সময়ে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় নদ-নদী যাতায়াত এমনকি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু দেশে দখলদারিত্বের ফলে নদ-নদী ও জলাশয়গুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আইনি কাঠামোর স্বরূপ, সরকারি উদ্যোগ-আন্তরিকতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার বিষয়টিও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবেশ সংবেদনশীল অবকাঠামো নির্মাণ না করার বিষয়টি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে যা আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর বিরূপ অভিঘাত ফেলছে। এই বিরূপ অভিঘাত বিভিন্নভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসবেরই ফল। বলা বাহুল্য, দেশের ছোট-মাঝারি-বড় নদী সবগুলোই রক্ষা করতে হবে। সব নদীরই সমান গুরুত্ব না হলেও কোনো নদীকে বাতিল করার সুযোগ নেই। নদী সুরক্ষায় আমাদের দেশীয় আইন বেশ শক্ত। আইন প্রয়োগের অভাবেও নদী হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে জোর করে নদী ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ করছে। প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অবৈধভাবে জলাশয় থেকে মাটি উত্তোলন কিংবা জমি ভরাট করার ফলে পার্শ্ববর্তী মূল সড়ক দেবে যাচ্ছে। অর্থাৎ জলাশয় বিলুপ্ত হলে যে শুধু পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন নয়। বরং আমাদের চারপাশের অবকাঠামোতেও বিরূপ প্রভাব পড়ে।
ক্লাইম্যাট রেজিলিয়েন্সে অধ্যাপনা করার খাতিরে বলতে পারি, বিগত পনেরো বছরে দেশে নদ-নদীর সুরক্ষায় আমরা উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম করতে পারিনি। নদীর অবৈধ দখলদারদের পরম যত্নে রাখা হয়। নদীবিষয়ক অপরাধে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দিতে তেমনটা দেখা যায় না। বরং যে কর্মীরা স্বেচ্ছায় নদী সুরক্ষায় কাজ করতে আসেন তাদের দখলদার এবং প্রশাসন মিলে হেনস্থা করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। অর্ধশতাধিক বছরে ভূমি আইন, পানি আইন, জলমহাল ব্যবস্থাপনা আইনসহ যত আইন হয়েছে তার কোনোটি নদী সুরক্ষার বিপরীতে নয়। তারপরও দেশে এমন একটি নদীর কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না, যে নদীটি নিরাপদ আছে কিংবা যে নদীর ভবিষ্যৎ ঠিকঠাক আছে। আমরা জানি, ব্রিটিশ শাসনামলে ভূমি জরিপ হয়েছে। সিএস নামে যে জরিপ হয়েছে সেই জরিপটি অনেক গ্রহণযোগ্য। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও এরচেয়ে আর ভালো কোনো জরিপ আমাদের কাছে নেই। এই জরিপের মাধ্যমে যেগুলো নদী-খাল-বিল-জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সেগুলোর শ্রেণি পরিবর্তনের যেমন সুযোগ নেই তেমনি এগুলোর মালিক ব্যক্তি হওয়ার আইনগত ভিত্তি নেই। বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে যেগুলো নদী-খাল-বিল-জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সেগুলোর শ্রেণি পরিবর্তনের যেমন সুযোগ নেই তেমনি এগুলোর মালিক ব্যক্তি হওয়ার আইনগত ভিত্তি নেই।
১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যত আইন-বিধি তৈরি করা হয়েছে তার কোনোটি নদীর দখল-দূষণ তথা নদীর ক্ষতি করার বৈধতা দেয় না। এমনকি সাংবিধানিকভাবে নদী রক্ষার কথায় বলা হয়েছে। সংবিধান-আইনের আলোকে আদালতও নদী সুরক্ষায় তাগিদ দিয়ে রায় প্রকাশ করেছে। তারপরও নদীর ক্ষতি হচ্ছে প্রকাশ্যে। বিগত কয়েক দশকে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। জনগণের প্রয়োজনে আমাদের দেশে সড়কপথ, রেলপথ তৈরি করা হয়েছে। সে সময়ে একবারও ভাবা হয়নি নদীর কথা। আবার যেসব স্থানে সেতু তৈরি করা হয়েছে সেগুলো প্রায় সবক্ষেত্রেই নদীর প্রকৃত মাপের চেয়ে ছোট। ফলে সেই সেতুগুলোও নদীর ভীষণ ক্ষতি করছে। আমাদের দেশে অনেক স্থানে নদীর ওপর দিয়ে আড়াআড়ি সড়ক এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে কোনো সেতু দেওয়াই হয়নি। নদীর সর্বনাশ করাও বন্ধ হয়নি। যে সর্বনাশ থেকে নদীগুলো রক্ষা করা সম্ভব তা করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে নদী সুরক্ষার দাবিতে সামাজিক সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তাও যৎসামান্য।
নদীগুলো প্রধানত দেখভাল করার কথা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তাদের কাজের পরিধি এতটাই বেশি যে তাদের পক্ষে আলাদা করে নদীর প্রতি মনোযোগ দেওয়া কঠিন। ফলে কোনো কোনো জেলাপ্রশাসক নদীর প্রতি আন্তরিক হলেও নদী রক্ষা করাটা কেবল স্বপ্নের মধ্যেই থাকে। আমাদের দেশের নদীগুলো উদ্ধারে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতো। তা অতীতে কখনো করেনি। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশনের ক্ষমতা এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে তারা যেন দখলদার কিংবা দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে। কেবল সুপারিশ করার ক্ষমতা আছে কমিশনের। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আইন প্রণয়নের কথা বলা হলেও তা আর করা হয়নি। আমাদের একটি নদী গবেষণা ইন্সটিটিউট আছে। এই প্রতিষ্ঠানটিও কার্যত অকার্যকর। অনেক বড় সম্ভাবনা নিয়ে এর যাত্রা শুরু হলেও এটিও এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন গঠিত হলেও সেটিও ভালোভাবে ক্রিয়াশীল নয়। কারণ নদীর সংজ্ঞা ও প্রকৃত সংখ্যা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। এসবের সমাধান হওয়া জরুরি।
দেশে কয়েক ধরনের নদী আছে। দেশ বিবেচনায় কিছু নদী আন্তদেশীয়। যেগুলোর উৎস নিজেদের দেশে সমুদ্র কিংবা নদীতে মিলনস্থলও নিজেদের দেশে। কিছু নদী আছে যেগুলোর উৎস ভারতে, কিছু আছে মিয়ানমারের সাথে। চীনে উৎপন্ন হয়ে ভারত হয়েও বাংলাদেশে আসা নদী আছে। ভুটানে উৎপন্ন হয়েও কিছু নদী বাংলাদেশে এসেছে। কিছু নদী দেশে উৎপন্ন হয়ে ভারতে গেছে। এমনও আছে ভারতে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে আবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছে। যে নদীগুলো একাধিক দেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এ নদীদের বলা হয় আন্তসীমান্ত নদী। দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছরেও এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে এই আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। কেবল তাই নয়, দেশে মোট নদী কতগুলো সে পরিসংখ্যানও সরকারের কাছে আছে কিনা সন্দেহ। আন্তসীমান্ত নদীতে অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশন হয়। বিভিন্ন শর্তপূরণ সাপেক্ষে এই কনভেনশনটি ২০১৪ সালে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত হতাশাজনক বিষয় হলো এতদিনেও বাংলাদেশে এটিতে অণুসমর্থন করেনি। ফলে আন্তসীমান্ত নদীগুলো থেকে আইন-বিধি-মানবিকতা-সভ্যতা-সম্প্রীতি সবকিছু বিনষ্ট করে ভারত পানি প্রত্যাহার করলেও তার প্রতিকার আন্তর্জাতিকভাবে ওই কনভেনশনের অধীনে বাংলাদেশ চাইতে পারছে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নদী সুরক্ষায় অনেকটা মনোযোগ দিয়েছে। তাদের গ্রহণ করা পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিকতা আলোর পথ দেখাতে পারে। নদী সুরক্ষায় বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি যাতে নদীগুলো সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নদী সুরক্ষায় অনেকটা মনোযোগ দিয়েছে। তাদের গ্রহণ করা পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিকতা আলোর পথ দেখাতে পারে। মনে রাখতে হবে, নদীর সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ধরনও জড়িত। এ বিষয়গুলো এড়িয়ে কোনোভাবেই নদীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আর নদী না বাঁচলে আমাদের অর্থনীতির সম্ভাবনাময় একটি অংশও ধ্বসে পড়বে যা আমাদের জীবনেও ফেলবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। পরিবেশ জলবায়ু ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি ( বেলা)-এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দীর্ঘকাল নদী নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে নদীর সংকট নিয়ে তিনি যতটা জানেন অন্যরা এতটা খুব কম জানেন। ফলে তার হাত ধরে নদী রক্ষার পথ সৃষ্টি হবে এটা নদীকর্মীরা মনে করেন।
দেশের ভূমির সাথে জীববৈচিত্র্যের সাথে নদীর সম্পর্ক প্রত্যক্ষ-গভীর এবং নির্ভরশীল। যদি আমাদের দেশের নদীগুলোর চরম সর্বনাশ হয় তাহলে এ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেবল বর্তমান প্রজন্ম নয় অনাগত দিনের কথা ভেবে হলেও আমাদের সবার আগে নদীগুলোর ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। নয়তো আগামী প্রজন্ম বসবাস উপযোগী বাংলাদেশ নাও পেতে পারে। এই দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার, সামাজিক সংগঠনের তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েরও। আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আমাদের দেশের নদীগুলো বাঁচতে পারে। ফলে এত বছরে যা হয়নি স্বল্পতম সময়ে আমরা সেই কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই। এর জন্য সচেতনতা এবং রাষ্ট্রের সদিচ্ছা জরুরি।