সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:২৬ এএম
কাকতালীয়ভাবে ১২ জানুয়ারি ছিল ‘হট টি ডে’ বা গরম চা দিবস। একইদিন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশ পেয়েছে ‘লোকসানের মুখে সংকটে চা শিল্প, বন্ধের উপক্রম’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। যা আমাদের চা শিল্পের জন্য উদ্বেগজনক। চা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। ঐতিহ্যগতভাবে চা রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। চা শিল্পের ওপর কয়েক লাখ শ্রমিক, কর্মচারীর জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। পরোক্ষভাবে আরও কয়েক লাখ লোক চা শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু বর্তমানে চা শিল্প কঠিনতম পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত, যা এই শিল্পের টিকে থাকার ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের এই অপার সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছে। যে শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর জীবন, যে শিল্পটি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতেও একটি বড় ভূমিকা রেখেছে, সেই শিল্পের টিকে থাকার লড়াইয়ে নামার খবর অর্থনীতির জন্যও অশনিসংকেত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলেটের চা শিল্প অব্যাহত লোকসানের মুখে রয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে, বেড়েছে চোরাচালান। এ ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকঋণ পরিশোধের উচ্চহারসহ নানামুখী কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে চা শিল্প। সমস্যাগুলো এতটাই প্রকট হয়ে উঠছে, যাতে করে আগামীতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেক বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কার কথাও বলছেন সংশ্লিষ্টরা; যা শুধু এই শিল্প সংশ্লিষ্টদেরই নয়, সাধারণের জন্যও দুশ্চিন্তার। চা শিল্পের সংকটের জন্য যে কারণগুলো সামনে এসেছে, তার মধ্যে দেশের বাইরে থেকে নিম্নমানের চা চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে আসা; মজুরি, তেল, রেশন, ওষুধ (অ্যাগ্রো কেমিক্যাল) ও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া; কয়েকটি বড় প্যাকেটিয়ার দ্বারা নিলাম বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাংকঋণ পরিশোধের উচ্চহার অন্যতম। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলে নিয়মবিবর্জিত পদ্ধতিতে চা উৎপাদন ও সরকারের আইন অমান্য করে সরাসরি ফ্যাক্টরি থেকে চা বিক্রয়ের প্রভাবের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
আমাদের চা বাগানের ইতিহাস ও ঐতিহ্যও দীর্ঘদিনের। ব্রিটিশদের হাত ধরে ভারতের আসাম এবং তার আশপাশে চা চাষের যে উদ্যোগ তাই সম্প্রসারিত হয় বাংলাদেশে। ইতিহাস বলছে, সিলেট শহরের উপকণ্ঠে ১৮৫৪ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য মালনিছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বাগানে চা উৎপাদনের মধ্য দিয়েই আমাদের চা শিল্পের যাত্রা। চা চাষের মাধ্যমে এ অঞ্চলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, তেমনি রপ্তানির মাধ্যমে চা জাতীয় অর্থনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে চা বোর্ডের নিবন্ধিত ছোট-বড় চায়ের বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এসব বাগানের ১৩৫টিই রয়েছে সিলেট অঞ্চলে। এখন লোকসানের মুখে সংকটে পড়ে যদি এ অঞ্চলের চা শিল্প বন্ধের উপক্রম হয়, তবে তা দুঃখজনকই শুধু নয়, অর্থনীতির জন্যও হুমকি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আমরা চা শিল্পকে যুগোপযোগী, আধুনিকায়ন ও প্রত্যাশিত মানে উন্নীত করার পাশাপাশি চা-শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার এবং জীবনমানেরও উন্নয়নের জন্য বলি। তাহলেই চা শিল্প উন্নতির শিখরে স্থান করে নেবে। বিভিন্ন সময়ে চা বাগানের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি ও আনুতোষিক সমন্বয়েরও আন্দোলন দানা বেঁধেছে। আমরা মনে করি, চা শিল্পকে রক্ষায় মালিক, শ্রমিক এবং সরকারÑ সব পক্ষকেই আন্তরিক হতে হবে। সব পক্ষের আন্তরিকতা ও পৃষ্ঠপোষকতাতেই উন্নত হবে চা শিল্প এবং এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের জীবনমান। আমাদের রপ্তানিকৃত চায়ের বড় বাজার পাকিস্তান ও আফগানিস্তান হলেও এই বাজার আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। নির্ধারিত বাজার হারালেও নতুন কোনো বাজার খুঁজে বের করাও সম্ভব হয়নি। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন মানসম্মত চা উৎপাদন হচ্ছে। ফলে আমাদের চা শিল্পকে দেশের বড় প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের বাইরে যেমন নতুন বাজার খুঁজে দেখা জরুরি, তেমনি দেশের ভেতরে চায়ের নির্ধারিত নিলাম মূল্য পর্যালোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া দেশের বাইরে থেকে কোনোভাবেই যেন চোরাই পথে চা আসতে না পারে, সে পথ বন্ধ করার পাশাপাশি ছোট কোম্পানি বা বাগানগুলোকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিতে হবে; যাতে তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে। চা শিল্পের সংকটের পেছনে যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়েছে, তার সমাধান খুব জটিল নয়। সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা আন্তরিকতার সঙ্গে চাইলে সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। চা শিল্প ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে, এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে না ফেলতে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে চা শিল্পকে শুধু বাঁচিয়ে তোলা নয়, বরং আরও চাঙ্গা করে তুলতে হবে।