দুর্নীতি
মাসুদ আহমেদ
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:২৪ এএম
মাসুদ আহমেদ
নিজ যোগ্যতা, পরিশ্রম এবং অবদানের বাইরে অর্জিত বা দখল করা সম্পদ ভোগ করাই হচ্ছে দুর্নীতির সংজ্ঞা। দুর্নীতি দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতিকে নির্দেশ করে। বৃহৎ পরিসরে ঘুষ প্রদান, সম্পত্তি আত্মসাৎ এবং সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত। দুর্নীতি শব্দটি যখন বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন সাংস্কৃতিক অর্থে ‘সমূলে বিনষ্ট হওয়া’কে নির্দেশ করে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল সর্বপ্রথম এবং সিসারো দুর্নীতি শব্দটি ব্যবহার করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মরিস লিখেছেন, দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার। দুর্নীতি বিভিন্ন মানদণ্ডে ঘটতে পারে। আওতা বা বিস্তৃতি ছোট হলে এবং তাতে যদি অল্পসংখ্যক মানুষ জড়িত থাকে তবে তাকে ‘ক্ষুদ্রার্থে’; আর যদি সরকার বড় আকারে প্রভাবিত হয়ে পড়ে তাকে ‘ব্যাপকার্থে’ দুর্নীতি হিসেবে নির্দেশিত হয়। এ অঞ্চলে ঘুষ-দুর্নীতির অস্তিত্ব ব্রিটিশ শাসনামলেও ছিল। দুর্নীতির উপস্থিতি এবং দুর্নীতি দমনের জন্য ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকার এ সম্পর্কিত আইন তৈরি করে। এরপর ধাপে ধাপে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৫৮ সালে ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৬০ সালে অ্যান্টি-করাপশন (ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ, ১৯৭৭ সালে ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট (স্যাংশন ফর প্রসিকিউশন) রুলস প্রণীত হয়। ধারাবাহিকভাবে প্রয়োজনের তাগিদে এসব আইন ও ধারার উপস্থিতি প্রমাণ করে, সব আমলেই ঘুষ-দুর্নীতির অস্তিত্ব ছিল।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আইন দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমন সম্ভব না হওয়ায় বাংলাদেশে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা তৈরি হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯৭৯ সালে প্রণয়ন ও কার্যকর হয় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল)বিধিমালা। আইনে যা-ই থাক না কেন, দুর্নীতির ধারণা এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ আমল থেকেই বিভিন্ন নামে আইন প্রণীত হতে হতে সব শেষে বাংলাদেশ-এ দুর্নীতি দমন কমিশন বাংলাদেশে কার্যকর রয়েছে। কমিশনের কর্মকর্তাদের হাতে এ বিষয়ে যে ক্ষমতা রয়েছে তা চলমান রেখে, পাশাপাশি উপস্থাপিত বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করার উদ্যোগ নিলে দুর্নীতির উৎসগুলো অনেকটা নিষ্ক্রিয় করা যাবে বলে আমাদের ধারণা। সমাজের অন্যতম ব্যাধি দুর্নীতি। দুর্নীতির বিষবৃক্ষ রাজনৈতিক সরকারগুলোর শাসনামলে বেশি ডালপালা ছড়ায় তা আমাদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে। ৫৩ বছরে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সমুজ্জ্বল হতো যদি দুর্নীতির শেকড়বাকড় না ছড়াত।
আমাদের বার্ষিক বাজেটের সিংহভাগ অর্থ যেহেতু আয়কর থেকে আহরিত হয় সেহেতু প্রথমে মনোযোগ দেওয়া দরকার দুর্নীতি রোধে। আয়করযোগ্য আয় আছে অথচ সংজ্ঞায়িত এবং শনাক্তযোগ্য কোনো পেশা বা কর্মস্থল নেই এমন প্রচুরসংখ্যক মানুষ আয়কর দিচ্ছে না বা আয়করের আওতায় আসছে নাÑ যা বেআইনি। এ পেশাগুলোর মধ্যে মাছ ব্যবসায়ী, সবজি ব্যবসায়ী, অন্যান্য কাঁচামাল ব্যবসায়ী, ছোট ফ্যাক্টরি, বড় কৃষক এবং এদের খুচরা ব্যবসায়ীরা অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু একটি কাঁচাবাজারে বসে এবং সেখানে কোনো পৌর-করপোরেশনের লাইসেন্স আইন প্রযোজ্য নয় বলে যারা এ ব্যবসাগুলো পরিচালনা করে করসীমার ওপরে মুনাফা করছেন, তাদের ব্যবসার কোনো ঠিকানাও নেই। দেশের অসংখ্য হাটবাজারে এদের নিত্য ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। আয়কর বিভাগের কাজ হবে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সার্ভেয়ার নিয়োগ করে লেনদেন চলার সময় এ স্থানগুলোতে কেনাবেচার হিসাব পরীক্ষা করে এদের বার্ষিক নিট আয় ও লাভ নির্ধারণ করা। যাতে তারা সকলেই তাদের আয়করের আওতায় আসে। মুঠোফোনের সাহায্যে এ শ্রেণির ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাইকেই একটা শৃঙ্খলায় আনা সম্ভব। এতে এরা প্রযোজ্য যে আয়কর সরকারকে প্রদান করছেন না, তা নির্ধারণ করে একটি বড় অংশই সরকারি কোষাগারে জমা করা যাবে। ফলে সমাজের সর্বত্র এ বাণীটি যাবে যে, আয়করযোগ্য আয় হলে যেকোনো নাগরিককে কর দিতে হবে।
এর প্রধান যুক্তি এই যে, দেশের সর্বত্র নির্মিত সরকারি স্থাপনা, নৌবন্দর, অন্যান্য বন্দর, সড়ক-মহাসড়ক, পুলিশ সেবা, পুল-কালভার্ট, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদি জনগণের করের অর্থে নির্মিত। কাজেই এগুলো ব্যবহার করা সত্ত্বেও যারা এর অর্থের উৎসে অবদান রাখছেন না অথচ তাদের করযোগ্য আয় রয়েছে, তাদের নৈতিক কারণেই এগুলো নির্মাণে কর প্রদানের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করতে হবে। জনগণের অর্থে জনস্বার্থে উন্নয়নমূলক কাজের অস্থিমজ্জা দুর্নীতির ঘুণপোকা কুরে কুরে খাবে তা তো হতে পারে না।
যেকোনো সম্পত্তির ভাড়া নির্ধারণের জন্য মেঝের আয়তন মাপার কাজটি বর্তমানে কর বিভাগের পরিদর্শক কর্তৃক করা হয়। সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, প্রকৃত মাপের চেয়ে কম মাপের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কর নির্ধারণে সরকার বিপুল পরিমাণ আয়কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ প্রাথমিক মাপ নেওয়ার জন্য অন্তত একজন সহকারী কমিশনারকে দায়িত্ব দিতে হবে। বিদেশ থেকে আগত যাত্রী যে বিদেশি মুদ্রা দেশে নিয়ে আসেন তা একটি সীমার ঊর্ধ্বে হলে বন্দরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে ঘোষণা দিতে হয়। কিন্তু এ মুদ্রা তিনি কোথায় বিক্রি করছেন তার তথ্য দিতে তিনি বাধ্য নন। ফলে চোরাবাজারে কিছুটা উচ্চমূল্যে এ মুদ্রা বিক্রি হচ্ছে। রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে চোরাকারবারি হতে উৎসাহ দিতে পারে না। এখন থেকে সব যাত্রীকে যেকোনো পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা কেবল নির্ধারিত ব্যাংকে বিক্রি করতে হবে। যেকোনো বাড়ির বা স্থাপনার ভাড়া ভাড়াটিয়া কর্তৃক মালিককে কেবল ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে প্রদান করতে হবে।
ভূমির সাবরেজিস্ট্রার অফিসে জমির সর্বোচ্চ মূল্য যা, বাজারমূল্য তার চাইতে দেশের অধিকাংশ স্থানে অনেক বেশি। কিন্তু দলিলে সরকার নির্ধারিত মূল্য দেখিয়ে জমির রেজিস্ট্রি করে বিক্রেতা অনেক কম অঙ্কের গেইন ট্যাক্স দেওয়ার ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে এ কম মূল্যে দলিল রেজিস্ট্রি করাতে সম্মত হওয়ায় সাবরেজিস্ট্রাররা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরও শক্তিশালী দুর্নীতিপরায়ণ শ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, দলিলে এ মিথ্যা তথ্য দেওয়ার সুবিধা প্রদান করে তারা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করছেন। জনসংখ্যার প্রচণ্ড চাপে জমির লভ্যতা দিনে দিনে কমছে। ফলে এ প্রবণতাও বাড়ছে। বিশেষ করে ভূমির সাবরেজিস্ট্রারদের আয়ব্যয় এবং সম্পদের হিসাব কর বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে বিচ্যুতিসমূহ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা কিংবা ভূমি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রকট চিত্র অতীতে বারবার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। নামজারি, রেজিস্ট্রিসহ সব ক্ষেত্রেই কমবেশি কদাচারের ছায়া রয়েছে।
ভ্যাট অধিদপ্তর সঠিকভাবে ভ্যাট আদায় করে কোষাগারে জমা দিচ্ছে কি না তা নিরীক্ষা করে নির্ণয় করার দায়িত্ব বরাবরই প্রজাতন্ত্রের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কর্মকর্তাদের ওপর ন্যস্ত ছিল। এতে অনেক দুর্নীতি নির্ণয় করে কোষাগারে আদায়যোগ্য অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু গত সরকার আইন করে এ প্রথা বাতিল করে তাকে শাসনতন্ত্রের অংশে পরিণত করে। শাসনতন্ত্রের এ ধারাটি বাতিল করে জনস্বার্থে আগের অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাঁচামালের মূল্য সবশেষে কিনে অর্থাৎ ব্যবহারকারীরা রীতিমতো অতিষ্ঠ এবং শোষিত। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে যখন বেগুনের মূল্য প্রতি কেজি ৩০ টাকা, তা ২ কোটি ৬৫ লাখ অধিবাসী অধ্যুষিত রাজধানীতে কমপক্ষে ৬৫ টাকা। মাত্র পাঁচটি হাতবদল হয়ে এ মুনাফা একান্ত অন্যায় এবং চরম দুর্নীতি। প্রথম বিক্রেতার কাছ থেকে শুরু করে সর্বশেষ খুচরা ব্যবসায়ী প্রতি ২ টাকা করে মুনাফা নিলেও এর দাম ৪০ টাকায় রাখা সম্ভব। সব পণ্যের জন্যই এটা প্রযোজ্য। এ বিষয়টির ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন কিছু নয়। বিশিষ্ট আইনবিদ, চিকিৎসক, স্থপতি, কনসালট্যান্ট ও প্রকৌশলীদের চেম্বারে দৈবচয়নের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত আয় এবং প্রদানকৃত আয়কর ও সম্পত্তির অর্থের উৎস আয়কর বিভাগ কর্তৃক নির্ণয় করে ত্রুটিবিচ্যুতি শাস্তিযোগ্য করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে অবহিতকরণের আইন করতে হবে। সবার আগে জরুরি সুশাসন। আমরা বিশ্বাস করি, সুশাসন নিশ্চিত হলে অপচ্ছায়া দূর হবেই। দায়িত্বশীল প্রত্যেককে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দিতে হবে নিষ্ঠার পরিচয়। তাহলেই আলো ছড়াবে সুশাসনের।