× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পর্যবেক্ষণ

সমাজ বাস্তবতায় সাংস্কৃতিক জাগরণ

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:১৯ এএম

মো. সাখাওয়াত হোসেন

মো. সাখাওয়াত হোসেন

সংস্কৃতি মানবসভ্যতার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। জীবনের পরতে পরতে সংস্কৃতির উপাদান জড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন ও ডিজিটালাইজেশনের কারণে সংস্কৃতির উপাদানগুলো বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিনিময় হয়। সঙ্গত কারণে সংস্কৃতির সঙ্গে উপসংস্কৃতির একটি যোগসাজশ থাকে। উপসংস্কৃতির প্রভাব যখন আধিক্য বিস্তার করে তখনই মূলত সাংস্কৃতিক সংকট তৈরি হয়, বিদেশনির্ভরতা চলে আসে অনেকের মধ্যে। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী এবং জাগরণ নিশ্চিত করতে হলে ব্যাপকভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যে পরিকল্পনায় বাংলাদেশের সব পেশা-শ্রেণির মানুষকে একীভূত করে নীতি প্রণয়ন করা দরকার। উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা এবং প্রাণের বিস্তীর্ণ আবেগে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসব আয়োজন করতে হবে। কারণ, সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে সকল প্রকার অনিয়ম, অন্যায়, নৈরাজ্য চিরতরে রুখে দেওয়া সম্ভব। জাগরণের মধ্য দিয়ে অনাবিষ্কৃত সভ্যতার নিদর্শনগুলো জাতীয় সম্পদে পরিচিতি পাবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ করে পর্যটন খাতে অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে।

বিশ্লেষক ও বোদ্ধাগণ সাংস্কৃতিক জাগরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তারা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন অনিয়ম, অসঙ্গতি, অপরাধ, নৈরাজ্য, সাম্প্রদায়িকতা থেকে জাতিকে সুরক্ষিত করার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে সাংস্কৃতিক জাগরণ। একমাত্র সাংস্কৃতিক জাগরণই পারে সব পেশা-শ্রেণির মানুষকে একসূত্রে, এক কাঠামোয়, সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারে দাঁড় করাতে। সাংস্কৃতিক জাগরণের মর্মার্থ হচ্ছে, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মেধা, মনন ও প্রজ্ঞায় বাংলার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করে সামনের পথচলায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে সব পেশা-শ্রেণির মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশ গড়ার শপথে দৃপ্ত কণ্ঠে স্লোগানের মাধ্যমে একই সুরে সুর মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ জীবনের জয়গান নিশ্চিতে কাজ করা। দেশের অধিকাংশ শ্রেণি পর্যায়ের মানুষকে সাংস্কৃতিক জাগরণের ধারায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব নয়। সাংস্কৃতিক জাগরণের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে সর্বসাধারণকে উদ্দেশ করে কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হয়। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যে অনুষ্ঠান, কর্মসূচি ও নীতিমালা প্রণয়ন করলে অনেক সময় বিষয়গুলো সর্বজনীন করতে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ই বি টাইলরের মতে, সংস্কৃতি অথবা সভ্যতা হচ্ছে এমন একটি জটিল সামগ্রিক সত্তা, যার ভেতর রয়েছে জ্ঞান, আস্থা-বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবোধ, আইন, প্রথা-পদ্ধতি এবং সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের অর্জিত অন্য সব দক্ষতা ও অভ্যাস। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার এবং পেজের মতে, সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনযাত্রা, চিন্তা ও প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ, যা তার শিল্পকলা, সাহিত্য, ধর্ম, বিনোদন ও উপভোগের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়। সুতরাং সংস্কৃতি হচ্ছে একজন মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা যার ভেতর দিয়ে চলাফেরা, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাষার ব্যবহার, শিল্পকলা, ধর্মীয় আচার আচরণ, পরিবার ও সমাজব্যবস্থা, পুরাণ কাহিনী, খাদ্যাভ্যাস, উৎসব ও পার্বণ, সরকারব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ের সমষ্টিকে একীভূত করে একটি সামষ্টিক ঘটনাপ্রবাহ। সংস্কৃতির যে বৈশিষ্ট্য ও নমুনায়ন সেটি একটি দীর্ঘ সময়ের বাস্তবতায় স্থায়ী রূপ নেয়। সংস্কৃতির উপাদানগুলো ধারণ ও লালনের মধ্য দিয়ে এর বিস্তৃতি ও স্থায়িত্ব ধরে রাখতে হয়। সঠিক চর্চা ও ব্যবহারের অভাবে সংস্কৃতির উপাদান কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়, তবে সংস্কৃতির চর্চা যে জাতি ধরে রাখার প্রয়াস গ্রহণ করে সে জাতিটি সামগ্রিকভাবে লাভবান ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি ধারণ করতে পারে দীর্ঘকাল।

সাব-কালচার তত্ত্বে মূলত ভিন্ন সংস্কৃতির বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও রীতিনীতির মাধ্যমে একজন ব্যক্তির অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার ব্যাপারটি বিশ্লেষণাত্মক আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। সমাজের প্রচলিত ধারা ও রীতিনীতির সঙ্গে উপধারা হিসেবে সংস্কৃতির সঙ্গে উপসংস্কৃতি প্রত্যয়টি উপযাজক হিসেবে অঙ্গাঙ্গিভাবে উঠে এসেছে। সাধারণত দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট পেশা-শ্রেণি কিংবা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে উপসংস্কৃতির উপাদানগুলো চলমান থাকে। কাজেই সমাজব্যবস্থায় সংস্কৃতির সঙ্গে উপসংস্কৃতির একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে যারা উপসংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে কিংবা উপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে যায় তারা সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তারা তাদের বৈশিষ্ট্যের অন্যদের সঙ্গে মেলবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা থেকেই আলাদা একটি বন্ধন তৈরি হয়।

সাংস্কৃতিক জাগরণের জন্য একটি আলোড়ন জরুরি। একটি শ্রেণি রয়েছে যারা দেশি সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুসঙ্গ বয়কট করে বিজাতীয় সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে এবং বিজাতীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী শ্রেণিটি সামগ্রিকভাবে বিজাতীয় সংস্কৃতি আয়ত্ত ও ব্যবহারোপযোগী হিসেবে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা না পাওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা, বেদনাবোধ ও অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। ফলে তারা নানা রকমের অপরাধ ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং সামাজিকভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবতারণা ঘটায়। মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আবদুল হাকিম বলেছিলেন, ‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়, নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়’। তিনি যথার্থই বলেছিলেন এবং বর্তমান সময়েও তার ভাষ্য প্রাসঙ্গিক। যারা এ দেশে থেকে, এ দেশের আলো-বাতাসে বড় হচ্ছে কিন্তু দেশি সংস্কৃতির ওপর আস্থা নেই, উপরন্তু তারা বিদেশি সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে নিজেদের আলাদা পরিচয় প্রদানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাদের বাংলাদেশে থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিলেতে ইংরেজি ভাষায় তার কবিগুণ প্রকাশ করতে সেখানে থিতু হয়েছিলেন। পরে বিদেশি ভাষায় ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে দেশি ভাষায় কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং সফল হন। তিনি তার কবিতায় বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে বিদেশি ভাষায় খ্যাতি অর্জনের ভুল সিদ্ধান্তের বিষয়ে তার পাঠকসমাজকে অবহিত করেন। এ ধরনের বহু ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে রয়েছে। নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, কৃষ্টি অবজ্ঞা করে অন্য সংস্কৃতিতে থিতু হয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সে কারণেই সাংস্কৃতিক জাগরণ অত্যন্ত প্রয়োজন যে জাগরণের মাধ্যমে দেশি গান, নৃত্য, কবিতা, নাটক, পুঁথি, দেশি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র ইত্যাদিকে ভালোবেসে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রায় তরুণ প্রজন্মের শামিল হওয়া জরুরি।

সংস্কৃতির উপাদান যত বেশি সমৃদ্ধ, সভ্যতার বিকাশেও ওই জাতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব। সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিচর্যা মূলত একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করতে পারে। আদিবাসীর বিভিন্ন ভাষা এখন বিলুপ্তপ্রায়। খবরের পাতায় মাঝেমধ্যে দেখা যায়, মাত্র দুজন একটি আদিবাসী ভাষা ধারণ করেছেন, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ জায়গাগুলোয় আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সংস্কৃতি একটি জাতির সুস্থির তথা সমৃদ্ধ অবস্থা তুলে ধরতে সহায়তা করে। আঞ্চলিক ভাষাগুলো বিশেষ করে আদিবাসী ভাষাগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে, সেজন্য পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, প্রবাদবাক্য প্রভৃতি বিষয়ের ব্যবহার ও অনুশীলন পর্যায়ক্রমে কমে আসছে। এ জায়গাগুলোয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যেমন জাতীয় পর্যায়ে লোকসংগীত, পুরোনো দিনের গান এবং উল্লিখিত গানসমূহ উপজীব্য করে প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে হবে। কেননা সংস্কৃতির চর্চা যত বেশি হবে সভ্যতার বিকাশমান ধারা তত বেশি পরিমাণে আলোড়িত হবে এবং আবিষ্কৃত হবে।

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেছেন, ‘আমরা যা তা আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে তা হলো সভ্যতা।’ পূর্বপুরুষের হাত ধরে আবহমানকাল ধরে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যে আচারাদিগুলো বাঙালির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তা বাঙালির সংস্কৃতি। বাংলার গান, কবিতা, চলচ্চিত্র, সংলাপ, নাটক, উৎসব, পার্বণ ইত্যাদি উৎস মানবজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। কাজেই এ বিষয়গুলোই বাঙালির জীবনের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির ওপর ভর করেই সামাজিক কাঠামোগুলো স্থিতিশীল হয়, গতিশীলতা পায় সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলো। নিজস্ব সংস্কৃতিতে যে জাতি যত বেশি শক্তিশালী এবং নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর অব্যাহত চর্চায় অনুশীলন করে সে জাতি কৃষ্টি-কালচারের দিক দিয়ে সমৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ।

  • সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা