সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫২ এএম
দেশে যাতায়াতের কোনো মাধ্যই যে নিরাপদ নয়Ñ এর অনেক মর্মন্তুদ নজির আমাদের সামনে রয়েছে। ‘অরক্ষিত রেলক্রসিং : অবহেলায় আর কত প্রাণহানি’ ১১ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ শিরোনামযুক্ত খবরের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলো নিয়ে যে পার্শ্ব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তা এ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আমরা দেখছি, শীর্ষ প্রতিবেদনে সংযুক্ত ছবিটিতে রেলক্রসিংয়ের কিনারে একটি সাইনবোর্ড। আখাউড়া-সিলেট রেলপথে ভানুগাছ রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ওই সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘সাবধান, এই রেল গেইটে কোনো গেইটম্যান নাই’। এ রকম ‘সাক্ষীগোপাল’ তুল্য সতর্কবার্তা দেশের অসংখ্য রেলক্রসিংয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে জারি করে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। রেলওয়ের দায়িত্বহীনতায় সৃষ্ট এই মৃত্যুফাঁদগুলো আমাদের উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত, যুগপৎ প্রশ্নমুখর না করে পারে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে মোট রেলক্রসিং রয়েছে ২ হাজার ৮শ ৫৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩শ ৬১টি অনুমোদনহীন এবং গেটম্যান নেই ৬শ ৩২টি ক্রসিংয়ে। এসব ক্রসিংয়ে বছরে মৃত্যুহার ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হলেও কর্তৃপক্ষের জিইয়ে থাকা দায়িত্বহীনতার উদাসীনতায় আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না।
চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা রেলক্রসিংয়ের এই বিবর্ণ চিত্র প্রশ্ন দাঁড় করায়, কর্তৃপক্ষের ‘কুম্ভকর্ণ’র নিন্দ্রা ভঙ্গ হবে কবে। এমনও কোনো জেলা কিংবা উপজেলা রয়েছে যেগুলোর ব্যস্ততম এলাকায় রেলক্রসিংগুলো অবস্থিত এবং সড়কের সংযোগস্থানে অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোতে নেই কোনো ব্যারিয়ার ও গেটম্যান। গেটম্যানবিহীন অননুমোদিত ক্রসিংয়ে যানবাহন পারাপার হতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা, হতাহতের তালিকা হচ্ছে দীর্ঘ। গত অক্টোবরে রোডস সেফটি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত জরিপে জানা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে সারা দেশে রেলের ১ হাজার ২শ ২৮টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪শ ৩ জন নিহত ও ১ হাজার ২শ ৬৯ জন আহত হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ের বৈধ-অবৈধ ক্রসিংগুলোর ৮৪ শতাংশই অরক্ষিত। আরও উদ্বেগজনক বার্তা হলো, রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি ঘটে সেগুলোর মধ্যে ৮৯ শতাংশই ঘটেছে অরক্ষিত ক্রসিংয়ের কারণে। রেলওয়ে এবং রেললাইন অতিক্রম করা সড়কগুলোর তদারক সংস্থা এলজিইডি, পৌরসভা কিংবা স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বিকারত্ব বিস্ময়কর!
দেশে যখন রেলপথ সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে তখনও অরিক্ষত রেলক্রসিংগুলোর উদ্বেগজনক চিত্র প্রশ্ন দাঁড় করাচ্ছে, রেলপথের উন্নয়নের নামে এ কোন কর্মযজ্ঞ ঘটছে? বাংলাদেশ রেলওয়ের অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলোর মৃত্যুফাঁদে পরিণত হওয়ার বার্তা এর আগেও প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ বিভিন্ন সময়ে খণ্ড খণ্ডভাবে উঠে এসেছে। কিন্তু ১১ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনসহ পার্শ্ব প্রতিবেদনগুলোতে ফের যে চিত্র উঠে এসেছে তা এক কথায় ভয়াবহ। রেল একটি নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা, তা সারা বিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রেল নিরাপদের পরিবর্তে কতটা বিপজ্জনক তা আমরা প্রায়শই দেখি। ‘নিজ দায়িত্বে পারাপার হোন/ পারাপারের সময় দুর্ঘটনার জন্য রেলকর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’Ñ এমন লেখা সংবলিত সাইনবোর্ডও রয়েছে দেশের লেভেল ক্রসিংগুলোর দুপাশে। ইতঃপূর্বে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছিলাম, ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ে দ্রুত ব্যারিয়ার ও গেটম্যান নিয়োগের বিষয়টি নাগরিক স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি এবং এই নিয়ে সময়ক্ষেপণের অবকাশ নেই। কিন্তু আমরা দেখছি, বাংলাদেশ রেলওয়েসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সব পক্ষই এ ব্যাপারে দায়িত্বহীনতার চিত্র স্পষ্ট করে তুলেছে এবং তারা তাদের দায়বোধ সম্পর্কে একেবারেই নির্বিকার!
আমরা জানি, রেলপথের একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সাধারণ মানুষের প্রবেশ আইনত দণ্ডনীয়। এ আইন কতটুকু মেনে চলা হচ্ছে, তাও দেখার কেউ নেই। রেলওয়ে অধ্যাদেশ ১৮৯০ অনুসারে বিনা অনুমতিতে রেলপথের ওপর দিয়ে হাঁটলে গ্রেপ্তারসহ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, আর কত মানুষের প্রাণ গেলে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল থামবে। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য, যেহেতু দেশে রেল দুর্ঘটনার অন্যতম একটি বড় কারণ অবৈধ ও অরক্ষিত রেলক্রসিং, সেহেতু অবিলম্বে এই মৃত্যুফাঁদ বন্ধের ব্যবস্থা নিতেই হবে। রেলপথ তো বটেই, যাতায়াতের যেকোনো মাধ্যমেই জননিরাপত্তার বিষয়টি জরুরি বিবেচনায় নিতে হবে। প্রতিটি রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান ও প্রতিবন্ধক বার থাকা নিশ্চিত করাও সমভাবেই জরুরি। অরক্ষিত রেলক্রসিং এবং অবহেলাজনিত দুর্ঘটনার দায় সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই এড়াতে পারে না। সড়ক ও রেলপথ যখন একই সমতলে এসে মিলিত হয় সেটাকেই বলা হয়, লেভেলক্রসিং, যা রাস্তার প্রধান চারটি বিপজ্জনক স্থানের মধ্যে একটি। অন্য তিনটি বিপজ্জনক স্থান হলো যথাক্রমেÑ রাস্তার বাঁক, সংযোগস্থল ও ব্রিজ বা কালভার্ট। রেলক্রসিংয়ে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায় যখন এর সঙ্গে অন্য তিনটির যেকোনো এক বা একাধিক বিপজ্জনক স্থানের সন্নিবেশ ঘটে। এমন বিপজ্জনক স্থান দেশে রয়েছে অনেক।
মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষিত থাকতে পারে না। এটা বিস্ময়কর যে, রেলওয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহনব্যবস্থা চলছে দায়িত্বহীনতা একই সঙ্গে বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, রেলের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকার ব্যয় করছে কিন্তু জননিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকটি উপেক্ষিত থাকছে কেন? আমরা রেলপথ সম্প্রসারণ করব, রেলগাড়ির সংখ্যা বাড়াব কিন্তু মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেব না, এটা তো হতে পারে না। রেলওয়ের নীতিনির্ধারকদের কাছে যদি মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব না পায় তবে ‘রেলের উন্নয়ন’-এর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন বিপন্নের হার আরও বাড়তে থাকবে। এমনটি তো কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। নিকট অতীতে রেলওয়ের দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সহযোগী একটি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছিল, অবৈধ ক্রসিংগুলো বন্ধে মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে অবৈধ রেলক্রসিং বাতিল করতে রেল মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনও জারি করেছিল। পরবর্তীতে রেল সচিবালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, নিরাপত্তার স্বার্থে রেলক্রসিংগুলোতে স্থানীয়ভাবে গেটম্যান নিয়োগ দেওয়ার, কিন্তু জনগুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি। সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে রেলক্রসিং সুরক্ষিত করাসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে আর কলক্ষেপণ কোনোভাবেই কম্য নয়।