× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আন্দোলন-সংগ্রাম

রাজনৈতিক ইতিহাসে স্লোগান সংস্কৃতি

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৪২ এএম

মযহারুল ইসলাম বাবলা

মযহারুল ইসলাম বাবলা

আমাদের ভূখণ্ডে কেন, সব দেশের আন্দোলনে, সংগ্রামে, বিপ্লবে, যুদ্ধে স্লোগান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। স্লোগানকে রণধ্বনিতুল্য বললেও ভুল হবে না। অধিকার আদায়ে, প্রতিবাদে প্রতিরোধে স্লোগানের অনিবার্যতা অস্বীকার করা যাবে না। স্লোগানই স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলন-সংগ্রাম সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারে। পারে আন্দোলনকারীদের উজ্জীবিত করতেও। স্লোগানের ভূমিকা ও তাৎপর্যের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে। রাজনৈতিক মতভেদে পাল্টাপাল্টি স্লোগানের সংস্কৃতিও রয়েছে। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামে জাতীয়তাবাদীদের পাশাপাশি বামপন্থিরাও ছিল। জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে বিরোধ না-থাকলেও দ্বিমত ছিল। জাতীয়তাবাদীরা কেবল জাতীয় মুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বামপন্থিরা আরও অগ্রসর হয়ে সমাজবিপ্লব সংঘটিত করে জনগণের মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। জাতীয় মুক্তিই যে শেষ কথা নয়, সেটা তো মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর থেকে এযাবৎ দৃশ্যমান বাস্তবতা রূপে আমাদের সামনে সেটা জাজ্বল্যমান।

ব্রিটিশ ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেস এবং গোপন সশস্ত্র যুগান্তর, অনুশীলন সমিতি ইত্যাদি জাতীয়তাবাদী ধারার স্লোগান ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের কবিতার (নাকি গান) ‘বন্দে মাতরম’। রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দে মাতরম’ কবিতাটির সুরারোপ করলেও জাতীয় কংগ্রেসকে অনুরোধ করেছিলেন ওই গানটি যেন জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার করা না হয়। গানটিতে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত স্বীকার করেছিলেন। কবি জসীমউদ্‌দীনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বন্দে মাতরম গানটি যেভাবে আছে, তোমরা মুসলমানরা এজন্য আপত্তি করতেই পার। কারণ এখানে তোমাদের ধর্মমত ক্ষুণ্ন হবার যথেষ্ট কারণ আছে।’ রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে পর্যন্ত জানিয়েছিলেন, ‘ভারতবর্ষে ন্যাশনাল গান এমন কোন গান হওয়া উচিত, যাতে এটা হিন্দু নয়। কিন্তু মুসলমান, খ্রিস্টান, এমন কী ব্রাহ্ম শ্রদ্ধার সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে যোগ দিতে পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলিম সম্প্রদায় ‘বন্দে মাতরম’ কেবল প্রত্যাখ্যানই করেনি, বিপরীতে অনুরূপ সাম্প্রদায়িক স্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছিল। ‘নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার’। হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তির ওই স্লোগানই অবশেষে ভারত বিভক্তি অনিবার্য করে তুলেছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের নিরিখে হস্তান্তরিত ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ঘটেছিল ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে মর্মান্তিক দেশভাগ।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ওই দুই সাম্প্রদায়িক স্লোগানের বিপরীতে যে স্লোগানটি সর্বভারতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার উপযুক্ত ছিল, সেটি সম্প্রদায়গত স্লোগানের তীব্রতায় গ্রহণ করেনি, না হিন্দু, না মুসলিমরা। সেটি হচ্ছে ‘জয় হিন্দ’। স্লোগানটির স্রষ্টা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সিঙ্গাপুরে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু তার গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার সুভাষ বসুর কাছে অর্পণের সময় উপস্থিত আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ শেষে সুভাষ বসু ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটি সর্বপ্রথম দিয়েছিলেন। ওই স্লোগানটি আজাদ হিন্দ ফৌজ গ্রহণ করেছিল বটে। কিন্তু ভারতীয় জনগণের ওপরও ‘জয় হিন্দ’ সাড়া ফেলতে পারেনি বন্দে মাতরম এবং নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার স্লোগানের দাপটে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ধর্মনিরপেক্ষ ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটি কংগ্রেস, মুসলিম লীগ গ্রহণ করলে সাম্প্রদায়িকতার গিলোটিনে দেশভাগ না-ও ঘটতে পারত। স্বাধীনতার পরক্ষণে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি জোর আওয়াজ তুলেছিল, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়-লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’। অতীব বাস্তবানুগ হলেও তীব্র সাম্প্রদায়িক আবহ এবং তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ডামাডোলে কমিউনিস্ট পার্টির সেই স্লোগান গ্রহণের অবস্থা আর তখন ছিল না।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলা অথচ বাংলা ভাষা উপেক্ষা করে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুসলমানদের উর্দু ভাষা রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেওয়া হয়। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রের ৫ শতাংশ মানুষেরও ভাষা উর্দু ছিল না। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচ, পাঠান প্রতিটি জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা ছিল। আরবি বর্ণমালার সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতি উর্দু ভাষাকে ধর্মীয় বিবেচনায় গ্রহণ করলেও পূর্ব বাংলার বাঙালিরা গ্রহণ করেনি। বিপরীতে ভাষার দাবিতে তীব্র প্রতিবাদ-সংগ্রাম শুরু করে। ভাষা আন্দোলনে কার্যকর স্লোগানটি ছিল, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। ত্যাগ-আত্মত্যাগে ভাষা আন্দোলন সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ স্লোগানটি সর্বস্তরে সাড়া ফেলতে পেরেছিল। অবশেষে পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

আমাদের ভাষিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ক্রমেই ওই আন্দোলন স্বাধিকার আন্দোলনে পরিণত হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদ, মতিউরের আত্মদানে পতন ঘটে আইয়ুব খানের। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে শহীদ আসাদের আত্মদানের পরক্ষণে ‘আসাদের মন্ত্র-জনগণতন্ত্র’ স্লোগানটি ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে। জাতীয়তাবাদীরা তখন নতুন স্লোগান দেয়, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা যমুনা’। বিপরীতে বামপন্থিরা দেয়, তোমার আমার ঠিকানা খেত-খামার-কারখানা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফাঁসানোর কারণেই মামলাটি গুরুত্ব হারিয়ে রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণের মামলায় পরিণত হয়। ওই মামলার বিরুদ্ধে সমস্বরে মানুষ স্লোগান দেয় ‘মিথ্যা মামলা আগরতলা-বাতিল করো, করতে হবে’। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা-মানি না, মানব না’। মামলা এগোয়নি, গণআন্দোলনে বাধ্য হয়ে সামরিক শাসক গোলটেবিল আহ্বান করে মামলা বাতিল এবং সব অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তার পরই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি জনসমক্ষে প্রথম আসে। 

১৯৭০-এর নির্বাচনে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগকে ওয়ার্ক ওভার দিয়েছিলেন এজন্য যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসুক। পাশাপাশি নিজেরা নির্বাচনী দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে সেটা পশ্চিম পাকিস্তানিদেরই স্বার্থ রক্ষা করবে। তাই তিনি কৌশলতা অবলম্বন করে স্লোগান দেন, ‘ভোটের আগে-ভাত চাই’। ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো-পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’। মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি সমবেতভাবে দিত। স্বাধীন দেশে হরেক স্লোগান বের হলেও এরশাদের শাসনামলের শেষ দিকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগানটি আলোড়ন তুলেছিল। শহীদ নূর হোসেন বুকে-পিঠে ওই স্লোগান লিখে মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হলে দেশব্যাপী এরশাদবিরোধী আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। রিকশাযাত্রী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ডা. মিলনকে গুলি করে হত্যার পর এরশাদের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। তখন স্লোগান ওঠে, ‘এক দফা-এক দাবিÑএরশাদ তুই এখন যাবি’। এ স্লোগানে গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদ ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হন।

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নানা পর্বের আন্দোলন-সংগ্রামে স্লোগানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ওইসব স্লোগানে থাকায় মানুষ তা গ্রহণ করে আন্দোলন বেগবান করে তোলে। আমাদের ভূখণ্ডের সব আন্দোলন-সংগ্রামে স্লোগান অপরিহার্য উপাদান হিসেবে সব সময়ই কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিতে স্লোগান অতীতের মতো সব সময়ই নতুন নতুন স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষায় মানুষকে উজ্জীবিত করেছে, আন্দোলনে শামিল করেছে। তবে আমাদের সমষ্টিগত মানুষের দুর্ভাগ্য এযাবৎকালের আন্দোলন-সংগ্রামের সাফল্যের সুফলভোগী তারা হতে পারেনি। বহু ত্যাগ-আত্মত্যাগেও সমষ্টিগত মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়নি। তাই ব্রিটিশ, পাকিস্তানি শাসনমুক্ত হয়ে স্বজাতির শাসনাধীনে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। সব মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্যও প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলো না। সেজন্য আরও নতুন স্লোগান আসবে, আন্দোলনের চাকা চলমান থাকবে। চলবে জনমুক্তির আন্দোলনও।

  • নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা