উন্নয়ন
ড. আদিল মুহাম্মদ খান
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:৫০ পিএম
ড. আদিল মুহাম্মদ খান
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় মেগা প্রকল্প নামে অবকাঠামোগুলোয় বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। সরকারের উন্নয়ন ভাবনার মধ্যে অবকাঠামো সর্বাগ্রে ঠাঁই পায়। পরিবেশ কিংবা গণতন্ত্র এক্ষেত্রে গৌণ বলে বিবেচিত হয়েছে। ফলে যেসব বড় প্রকল্প নেওয়া হয় তার সবগুলোই নানাবিধ সমালোচনার মুখে পড়ে। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহেশখালী ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সুন্দরবনে রামপাল কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এমনকি কক্সবাজারের সংরক্ষিত অঞ্চল দিয়েও অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আবার এমন অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যা ব্যবহারিক অর্থে জনবান্ধব নয়। যেমন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে রাজধানীর মানুষের যানজট নিরসনে বড় প্রভাব রাখতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে যানজটের সমস্যা বাড়িয়েছে। অথচ এই প্রকল্প অনেক গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রাজধানীর এসটিপি বা ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে এই প্রকল্পকে রাখা হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় পেছনের প্রকল্পটিই সামনে এনে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এক দশক ধরেই এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে এবং এখনও সম্পূর্ণরূপে অবকাঠামোটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। বিগত সরকারের আমলে শুরু করা অধিকাংশ প্রকল্পের কাজই এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। ফলে চাইলেও এখন এ প্রকল্পগুলো এড়ানো সম্ভব নয়।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা জাতীয় শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করে। এই কমিটি অনুসন্ধানের মাধ্যমে জেনেছে, সাতটি মেগা প্রকল্পে অন্তত ৮০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। নিকট অতীতে এ স্তম্ভেই লিখেছি, অনেক প্রকল্প মূলত দুর্নীতি কিংবা অর্থ আত্মসাৎ করার জন্যই অনুমোদিত হয়েছে। রামপাল কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশকাণ্ডের কথা আমাদের অজানা নয়। বিগত সময়ে যেসব মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা যায়নি। এতে করে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে সঙ্গে বেড়েছে প্রকল্পের খরচও। কখনও কখনও মেয়াদ দফায় দফায় কয়েক বছর বাড়ানো হয়েছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে খরচও। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় দীর্ঘ করে প্রকল্প ব্যয় দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানো হতো। এর ফলে অবকাঠামো বাস্তবায়ন হলেও আমরা বাস্তবে প্রকল্পগুলো থেকে সুফল প্রকৃতভাবে পাইনি। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয় এবং ব্যয় বাড়লে ঋণের সুদ যেমন বাড়ে, তেমনি ঋণ পরিশোধের সময়ও সংগতভাবেই বেড়ে যায়। যেকোনো পরিকল্পনা বা বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সবকিছু যাচাই-বাছাই ও হিসাব-নিকাশ করা হয়। এসব হিসাব-নিকাশ করার মাধ্যমে প্রকল্পে আনুমানিক কেমন সময় লাগতে পারে এবং কত খরচ হতে পারে, সবই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা যায়। এজন্য প্রকল্প পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশে পরিকল্পনার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পরিকল্পনার নামে যা হয়েছে তা অনেকটাই রুটিনওয়ার্ক। পেশাদার ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিকল্পনা করা হয়নি বলে প্রকল্পে নানা ত্রুটিবিচ্যুতি রয়ে গেছে এমনকি প্রকল্পের সুবিধাও সবাই সমানভাবে ভোগ করতে পারছেন না। তা ছাড়া পরিবেশ-প্রতিবেশ ও মানুষের আবাসন-জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও নানাভাবে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে।
সম্প্রতি পান্থকুঞ্জে গাছ রক্ষা আন্দোলন নামে একটি কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এই আন্দোলন মূলত পরিবেশ-প্রতিবেশ সংবেদনশীল প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টিকে জোর দিচ্ছে। এ ছাড়া জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় নয় কিংবা মেগা প্রকল্পের নামে লুটপাট বন্ধ করার বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়েছে। আমরা জানি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জংশন হওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে এই প্রকল্পটি রাজধানীর ভেতর অনেকগুলো জংশন তৈরি করেছে। ঢাকার ভেতরে এই জংশনগুলো তৈরি হওয়ায় ট্রাফিকের চাপ অনেক বেড়েছে। শেষ পর্যন্ত এফডিসি থেকে হাতিরঝিল জলাশয় ধ্বংস করে একটি সংযোগ তৈরি করা হলো। এই সংযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের মতো সংবেদনশীল এলাকায় নামবে। এমনটি হলে ওই এলাকায় যে নতুন কিছু প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে তা অনেকাংশে নিশ্চিত। এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়ক এ ধরনের অবকাঠামোর সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব কেমন হবে, তা যে মোটেও আমলে নেওয়া হয়নি, সে কথা স্পষ্ট। এজন্য মেগা প্রকল্পগুলো আজ রাষ্ট্রের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এই প্রকল্পগুলোয় যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়, তার ফিরতি আসবে কি না তাও নিশ্চিত নয়। কিন্তু যেহেতু অনেক প্রকল্প এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলোর কাজ বন্ধ করলে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় ঘটবে। তাই সরকারের উচিত, তাদের গঠন করা কমিটিগুলো থেকে প্রাপ্ত পরামর্শ অনুযায়ী চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা প্রকল্পগুলো যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে ফেলা। যদি এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে অন্তত প্রকল্পগুলো ব্যবহার করার সুযোগ হবে এবং কিছুটা হলেও মানুষের জীবন সহজ হতে শুরু করবে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু প্রকল্প অহেতুক বলে বাতিল করে দিয়েছে। এসব সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এবং যেসব প্রকল্পে বিনিয়োগের বদলে বাড়তি অর্থ আসার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেসব প্রকল্প এড়িয়ে যাওয়াই রাষ্ট্রের এই নাজুক সময়ে মঙ্গলজনক। বিগত সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা ভুল এড়িয়ে জনকল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টিকে জোর দিতে হবে। পূর্ববর্তী ভুলগুলো সংশোধনের মাধ্যমে আমাদের অপচয় কমাতে হবে। দেশের অর্থনীতি নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে থাকায় বিষয়টি বাড়তি গুরুত্বের দাবিদার। তাই এসব বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত জনকল্যাণমুখী ভাবনার বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
আমরা দেখেছি, রাজশাহী শহরে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এই শহরে যানজট এমনিতেই কম, এমনকি এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চলও প্রায় নেই বললে চলে। আঞ্চলিক কাঠামো বিবেচনায় রাজশাহীতে ফ্লাইওভারের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার পরও এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে প্রেস্টিজ ইস্যু এবং অনেকটাই রাজনৈতিক কারণে। যারা স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল, তাদের জন্য এই প্রকল্পগুলো উপহারস্বরূপ বলে বিবেচনা করা যায়। বিগত সরকারের উন্নয়ন ভাবনার ক্ষেত্রে অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে নিজেদের প্রেস্টিজ বাড়ানোর বিষয়টিই নগ্নভাবে চোখে ধরা পড়ে। তা ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, বড় বড় প্রকল্পে স্থানীয় নেতারা দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক অর্থ লোপাট করেছেন। আবার এমন কিছু প্রকল্পও হয়েছে যেখানে আমরা দেখেছি বাংলাদেশের টাকায় ট্রানজিট প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে এবং বাস্তবায়নের পর এর সুফলভোগী হবে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। এসব প্রকল্প শেষ পর্যন্ত দেশের বৃহৎ স্বার্থে বা বিনিয়োগ ফেরত আনার জন্য উপযোগী নয়। প্রায় সবক্ষেত্রেই পরিকল্পনা বিশ্লেষণ, প্রকল্প বিশ্লেষণ করা হয়নি। রামপাল কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে জনমনে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। যেহেতু এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে তাই আমাদের আবার প্রথম থেকে সংস্কারের সুযোগ নেই। কিন্তু সামনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে, সেগুলো সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্পের কাজ শুরু করার আগে বিশদভাবে প্রকল্পের ব্যয়, সম্ভাব্যতা, আঞ্চলিক প্রভাব এবং বিনিয়োগের পর ফিরতি অর্থের সম্ভাব্যতার হিসাব-নিকাশ ও যাচাই করতে হবে। এই চর্চা আমাদের শুরু করতে হবে। আগের সরকারের মধ্যে এই চর্চা ছিল না বিধায় প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি ও অর্থের অপচয় ঘটেছে। প্রকল্প নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে সমালোচনা করলে হবে না। বরং এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের ভূমিকা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে প্রস্তাবনাগুলো উপস্থাপন করতে হবে। যদি এমনটি করা যায়, তাহলে বিদায়ি সরকারের ন্যারেটিভ দূর করা যাবে। আওয়ামী লীগ সরকার ‘উন্নয়ন আগে, পরিবেশ পড়ে’Ñ এমন একটি ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল। আমাদের এ ধরনের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি তা না করা যায়, তাহলে কোনোভাবেই অবকাঠামোগত উন্নয়নের পূর্ণাঙ্গ সুফল আমরা পাব না। বরং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সংস্কৃতি গড়তে না পারায় আমাদের নানাবিধ সংকটের মুখে পড়তে হবে এবং তা আস্তে আস্তে রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে থাকবে।