মধ্যপ্রাচ্য
লুবনা মাসারওয়া
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:৪৬ পিএম
লুবনা মাসারওয়া
২৮ ডিসেম্বর গাজার পশ্চিম তীরের শহর সিলওয়ানের এক গ্রামে ইসরায়েলি সেটলাররা আক্রমণ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, দুজন বয়স্ক ফিলিস্তিনি জলপাই বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ আর মাথা বেয়ে রক্ত ঝরছে। দুজনই গুরুতর আহত এবং দুজনের গাড়িও ভেঙে ফেলা হয়েছে। পশ্চিম তীরে সেটলারদের এমন আক্রমণের ঘটনা বাড়তে শুরু করেছে। নিরাপত্তাহীন ফিলিস্তিনিদের ওপর ঘন ঘন আক্রমণ চালানো হচ্ছে। ফিলিস্তিনি অথরিটি (পিএ) দীর্ঘদিন তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসেবে নিজ দেশের মানুষের ওপর আক্রমণের পথই বেছে নিচ্ছে। ২৯ ডিসেম্বর পিএ সিকিউরিটি সার্ভিসের স্নাইপাররা ২১ বছর বয়স্ক তরুণ সাংবাদিক সাত্তা আল সাবাঘকে গুলি করে হত্যা করে। সাবাঘ জেনিন ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীদের কর্মকাণ্ড সংগ্রহ করছিলেন। তার ভাই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘ও মহিলা বলেই এমন হয়েছে। তা ছাড়া ওর সঙ্গে বাচ্চা ছিল। তারপরও স্নাইপাররা তাকে গুলি করেছে। তাও কি না যখন ও মাত্র বাসা থেকে বেরুচ্ছিল।’
গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই পিএ শরণার্থী শিবিরে হামলা করছে। বিশেষত জেনিনে এসব হামলা হচ্ছে বেশি। জেরুজালেম থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে উত্তরের শহরে অভিযান চালিয়েছে মূলত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের হাত থেকে ক্যাম্পকে মুক্ত করার জন্য। পশ্চিমা গোষ্ঠীর নীরবতার কারণে পিএ নিজের দেশের মানুষের সঙ্গেই যুদ্ধ করতে শুরু করেছে। যারা প্রতিবাদ করছে তাদের সবাইকে এই ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অন্তত ১৬ জন নিহত হয়। ৩ জানুয়ারি এক বাবা ও তার ছেলে গুলিতে মারা যায়। ফিলিস্তিনের মানুষ এখন শোচনীয় পরিবেশে বাস করছে। শুধু ইসরায়েলি আগ্রাসনই নয়, তাদের নীতিনির্ধারণী কাঠামোও নানাভাবে অত্যাচার চালাচ্ছে।
গাজায় গণহত্যা চলমান। ২০২৪ সালে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেটলারদের আক্রমণ অতীতের যেকোনো সময়কে ছাপিয়ে গেছে। ২০২৩ সালের পর দিনে অন্তত চারবার করে হামলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অপ্রত্যক্ষভাবে ইসরায়েল গাজাকে জনশূন্য করার এ কাজটি করছে। পশ্চিমাদের নীরবতার কারণে ফিলিস্তিনিরা এখন অস্তিত্বসংকটের মুখে। তা ছাড়া কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে ফিলিস্তিনি অথরিটিও এখন গণহত্যা চালাচ্ছে।
একজন ফিলিস্তিনি কলামিস্ট আমাকে বলেছিলেন, পিএ নিরাপত্তা বাহিনী পাঁচজনকে ধরে নিয়ে গেছে, কারণ তারা তার এক নিবন্ধের বিষয়ে প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সমর্থন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য লিখেছিল। পরিবেশ এতটাই উত্তেজনাপূর্ণ যে আমার কিছু সাংবাদিক বন্ধু ছদ্মনামে গল্প প্রকাশ করছেন। অনেক ফিলিস্তিনির জন্য, পিএ-এর অধীনে বসবাস এবং কাজ করা সব সময় কঠিন ছিল, কিন্তু আমার মনে হয় না কেউ কল্পনা করেছিল যে হত্যা এবং গ্রেপ্তারের মাত্রা এত বড় উচ্চতায় পৌঁছাবে।
মনে হচ্ছে, পিএ নিজেকে একটি নতুন শত্রু হিসেবে আবিষ্কার করেছে এবং এটি ইসরায়েলি বাহিনী বা অবৈধ বসতি স্থাপনকারী নয়। একজন ফিলিস্তিনি কর্মী আমাকে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘তারা (পিএ) কোনো প্রতিরোধে আগ্রহী নয় এবং তারা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বা পিএ-এর সমালোচনাকারী যে কাউকে গ্রেপ্তার করছে। এটি সবই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের চাপে করা হয়েছে। পিএ বা জেনিনে তারা যা করছে তার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেকোনো পোস্ট আপনাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার হতে দেখা যাবে।’
পিএ যেভাবেই বিষয়টি এড়ানোর চেষ্টা করুক না কেন, এসব প্রচারণা অনেক বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রমাণিত হয়েছে। পিএ-এর প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ফাতাহ-এর একজন ব্যক্তি বলেছেন, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে যে আচরণ করছে তার সঙ্গে মৌলিকভাবে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে, ‘পিএ ফিলিস্তিনি জনগণের কথা চিন্তা করে নাÑ তারা কেবল ইসরায়েলি এবং আমেরিকানদের বোঝাতে চায় যে তারা পশ্চিম তীরে নিরাপত্তা অর্জন করতে পারে।’ তার মতে ফিলিস্তিনি অথরিটি যে লক্ষ্য অর্জন করতে চাচ্ছে, তা এভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে না। বরং তা বিভাজন আরও বাড়াবে।
গত মাসে, অ্যাক্সিওস রিপোর্ট করেছিল যে জেনিনে পিএ-এর আক্রমণকে সংস্থার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস আসন্ন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা পাঠাতে আগ্রহী যে, তিনি ফিলিস্তিনি বিষয়গুলো পরিচালনা করতে পারেন। এখন পর্যন্ত, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষও পিএ-এর দমন-পীড়নকে স্বাগত জানিয়েছে, ইসরায়েলি চ্যানেল কান জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এমনকি আক্রমণকে উৎসাহিত করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে কান বলেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ‘শরণার্থী শিবিরে কার্যকলাপকে সুশৃঙ্খল করার জন্য ঊর্ধ্বতন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ’ করেছে।
অদ্ভুত হলেও সত্য, পিএ-এর দমন-পীড়ন, যার ফলে পশ্চিম তীরে আলজাজিরার সম্প্রচারও স্থগিত করা হয়েছে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ গাজা থেকে আসা যেকোনো এবং সমস্ত প্রতিবেদন সীমাবদ্ধ করে চলেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আরবি ভাষার মুখপাত্র, আভিচায় আদরাই, বারবার আলজাজিরাকে দানবীয় প্রমাণের জন্য পোস্ট করেছেন। তার বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি পশ্চিমাদের কাছে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে। এ ধরনের উপস্থাপন কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ধারণা পৌঁছে দিতে পারে। এই সংকটময় মুহূর্তে, যখন ইসরায়েল গাজা, সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়েমেনে বহুমুখী আক্রমণে লিপ্ত, তখন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) আবারও তাদের কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসরায়েলি দখলদারত্বের হাতিয়ার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছে। এমন সংকট বরং ফিলিস্তিনের জন্য একটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়াবে। এই সংকট থেকে সহজে উত্তরণের পথ নেই। কারণ নিজের দেশের মানুষের সঙ্গেই যুদ্ধ চালিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা সম্ভব না।
মিডল ইস্ট আই থেকে অনুবাদ : আবেদিন আকাশ