× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সমাজ

প্রবীণের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

রোকেয়া ইসলাম

প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৩১ এএম

রোকেয়া ইসলাম

রোকেয়া ইসলাম

পরিবর্তন চিরস্থায়ী ব্যবস্থা, পরিবর্তন প্রাকৃতিক। ঋতুবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ, আবহাওয়া। বদলে যায় মানুষের মন, শরীর এবং জীবনব্যবস্থা। মানুষের জীবনও স্তরে স্তরে বদলায়। বয়সের সঙ্গে সময়ের সঙ্গে দেশকালপাত্রে বদলায়। বদলকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার মাধ্যমেই জীবনব্যবস্থার প্রবহমান গতিকে সচল ও সুন্দর রাখা সহজ হয়। জীবনের উদিত সূর্য শৈশব সময়কে আলোকিত করে জানিয়ে দেয় সমূহ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত। এ সময় অভিভাবকদের রয়েছে বাড়তি গুরুত্ব। তাদের মাধ্যমেই শিশুর বিকাশ পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা যায় এবং এ ক্ষেত্রে সতর্কতা ও আন্তরিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর জন্য উপযোগী পোশাক নির্বাচনে প্রয়োজন ও রুচির প্রকাশ ঘটায় পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য। এরপর শিশু বড় হতে থাকে, গড়ে উঠতে থাকে তার নিজের রুচি, পারিপার্শ্বিক সাহচর্য এবং পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পাশাপাশি তখন তার ভাবনায় আবহাওয়া পরব এবং প্রয়োজনীয় আরও অন্যান্য বিষয়ও যুক্ত হতে থাকে।

সোনালি তারুণ্য প্রখর যৌবন সেখানে তার নিজের রুচি ও সামর্থ্য প্রবলভাবে বহির্প্রকাশ ঘটে। একজন মানুষ যখন প্রবীণ হয়, হারিয়ে যায় তার শারীরিক শক্তি, অর্থনৈতিক অবস্থা। অনেক প্রবীণের জন্যই হারিয়ে যায় সামাজিক সখ্য, কখনও কখনও পরিবারের কাছে সে ঝামেলা ও বোঝা হয়ে ওঠে। বিষয়টি অনেক সময় সামাজিক পর্যায়েও বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ নিয়ে অতীতেও বহু আলোচনা হয়েছে কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশের চর্চা সমষ্টিগতভাবে নেওয়া যায়নি। প্রবীণের অনেক প্রয়োজন চাপা পড়ে যায় পারিবারিক চাপে। এমনকি তারা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও পান না। সারাজীবন তারা পরিবারের জন্য যে আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন তা নিমেষেই ক্ষুদ্র পরিবারের নাগরিক ধারণায় বিসর্জনের মুখে পড়ে। আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় বৃদ্ধাশ্রম বেড়েছে এবং সেখানে সুযোগ-সুবিধাও কম নয়। কিন্তু অধিকাংশ প্রবীণ এসব জায়গায় যেতে চান না। তাদের ভাবনায় থাকে, যত কষ্টই হোক সন্তানের কাছাকাছি বা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারলেও সুখ। পারিবারিক মেলবন্ধনের এই ভাবনা পুরোনো প্রজন্মের মধ্যে দৃঢ়ভাবে রয়েছে। এমন ভাবনায় থাকায় অনেকেই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে চান না। যেহেতু দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা সুশৃঙ্খল নয় সে ক্ষেত্রে প্রবীণরা নানাবিধ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। বিশেষত, নারীরা এখনও অনেক বেশি বৈষম্যের শিকার। নারীর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমের স্বীকৃতি নেই। তাদের সঞ্চয়ের সুযোগ কম এবং দেশের সিংহভাগ নারীকে রান্নাঘরেই জীবনের বড় একটি অংশ কাটাতে হয়। এই নারী প্রবীণ বয়সে সন্তানের সঙ্গে থাকতে চায়। কিন্তু নাগরিক জীবনে যখন ব্যয়নির্বাহ করা কঠিন হয়ে উঠছে তখন ক্ষুদ্র পরিবারের চিন্তায় অনেকেই প্রবীণদের বোঝা মনে করেন। এই ভাবনা থেকেই প্রবীণদের সঙ্গে এক ধরনের বাজে আচরণ করা হয়। আবার অনেক সময় তাদের সুযোগ-সুবিধা, আরাম ও বিনোদনের চাহিদাকে উপেক্ষা করা হয়। নতুন প্রজন্ম প্রবীণদের পুরোনো ও অকেজো প্রজন্ম হিসেবে বিবেচনা করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করে, যা মোটেও সমীচীন নয়।

প্রবীণদের এই পারিবারিক চাপের সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক নির্ধারিত চাপ সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়টাও জোরালো হচ্ছে। প্রবীণদের জন্য সমাজ নির্ধারণ করেই রেখেছে একেবারে সাদামাটা রঙ, নিম্নমানের পোশাক এবং যা সংখ্যাতেও অপ্রতুল। নারীদের বিষয় তো আরও করুণ। প্রবীণ বয়সে তাদের অনেকেরই না থাকে জমানো টাকা, না থাকে সম্পদ। থাকে শুধু ঘর। তাও অধিকাংশ সময়ই শূন্য। আর যাদের ঘর আছে, পূর্ণতাও আছে, তাদের আরও আছে শরীর ভর্তি রোগ সঙ্গে মন ভর্তি ভালোবাসা যত্ন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। মনটা তো সংসার সন্তানের কর্তব্য পালনের চাপে চুপসে থাকলেও এখন ডানা মেলতে চায়। রঙিন পোশাক পরতে মন চায়। হালকা গহনা পরতে মন চায়। হাতের লাঠিটাও আরামদায়ক রুচিশীল চাই। চোখের চশমাটাও একটু ফ্যাশনেবল হোক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাদুকা জোড়া। এটার হেরফের হলে মচকে পা ভাঙতে পারে। এটার জন্য চাই মেডিকেটেড জুতা। সেটার দাম সাধারণত একটু বেশি তো বটেই, অনেক সময় অনেকের সাধ্যেরও বাইরে। সমাজে প্রবীণদের জন্য কাজের কোনো সুযোগ নেই। পরিবারে সবচেয়ে অবহেলিত ব্যক্তিটি হলেন সংসারের প্রবীণ ব্যক্তি। তার আয় নেই, তাই তার মতামতও অনেকে গণ্য করে না। অথচ এই ব্যক্তিই একসময় পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস ছিলেন। অতীত আমরা সহজে ভুলে যেতে পারি বলেই সামাজিকভাবে এ ধরনের সংকটগুলো জিইয়ে থাকছে। 

বাড়িতে ছাদ বাগান বা বারান্দায় বাগান করলেও সে গাছপালাগুলোর জন্য যে মনোযোগ, গাছগুলোর যে যত্ন করা হয় তার বিন্দুমাত্র যত্নও অনেক প্রবীণের ভাগ্যে জোটে না। কেউ কেউ কুকুর বেড়াল পালে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ভালোবাসা যত্ন কখনও আদিখ্যেতাও দেখানো হয়। অথচ সেই সংসারেই প্রবীণব্যক্তিটি যত্নের বেলায় থাকেন ওই প্রাণীদেরও নিচে। বুয়া, ড্রাইভার, মালি, দারোয়ান এদের মূল্যের এক কণাও প্রবীণের জন্য বরাদ্দ হয় না। কখনও এদের দিয়ে অপমানও করা হয় পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের। পরিবারে মূল্যহীন প্রবীণ আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র এবং ওষুধের জন্য প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হয়। সেখানে তার জন্য আরামদায়ক রুচিসম্মত পছন্দমতো পোশাক তো স্বপ্নেরও বাইরে। কোনো উৎসব-পরবে সবার জন্য পোশাকসহ পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বাজেট ফুরিয়ে যায়। কিন্তু বাদ থাকে শুধু প্রবীণ। তাকে না দিলে নানাজন নানাকথা বলবে, তখন এই সংকটে একটাই উপায়, প্রবীণের জন্য যা হোক একটা কিছু কেনা। কেনা তো হলো। সে তো আর বাইরে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাবে না, থাকবে তো বাড়িতেই। তার বিবর্ণ বয়সে ততোধিক বিবর্ণ পোশাক রঙ ডিজাইন তো তৈরিই আছে। কেনার জন্য দোকানে গেলে বিক্রেতা জিজ্ঞেস করে কার জন্য? মুরুব্বির জন্য তো। বের করে তাদের রুচিমতো এমনসব তৈরি পোশাক। আজকাল অনলাইন শপিংয়েও অবস্থা তেমনই। তাদের গালভরা বাচনে একটা কথাই স্পষ্ট হয় সেটা হলো প্রবীণদের পোশাক একটু আলাদা হবে, রঙ ডিজাইন হবে ম্যাড়মেড়ে। এসব বিষয়ের একটাই অর্থ, বুড়োদের নিজেদের কোনো পছন্দ নেই। তাদের বিবর্ণ জীবন আরও বিবর্ণ করে ফুটিয়ে তুলতে হবে পোশাকে, চাপিয়ে দিতে হবে অন্যের পছন্দ। তারা নিজের জীবনকে রঙহীন করে দেশ, সমাজ, পরিবারকে রঙিন করেছেÑ এটা ভুলে গেছে, ভুলে যেতে হয়েছে।

প্রশ্নটা হয়তো এমনই এরা বেঁচে আছে কেন? ঝামেলা হয়ে, বোঝা হয়ে। টগবগে তারুণ্যের ছিপছিপে গড়ন  তাদের নেই। র‍্যাম্পে হাঁটার মতো আকর্ষণীয় দেহপল্লব, টানটান পেশি, জেল্লাই দেওয়া ত্বকের জোরালো পা তাদের নেই। ষাটটি বসন্ত তো হারিয়ে গেছে ডায়াবেটিস, হাড়ক্ষয়, ইউরিক অ্যাসিড, বাতব্যথাসহ নানরকমের বয়সি আক্রমণে। সামাজিক ও পারিবারিক চাপে ক্ষতবিক্ষত মন। এই মানুষদের জন্য পোশাক নির্বাচনে প্রথমেই ভাবা প্রয়োজন তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা। কতটা আবহাওয়া উপযোগী, কতটা তাদের ধারণ উপযোগী, পোশাক আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত কি নাÑ এ দিকগুলোও। অথচ আমরা কজন পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের জন্য এমন করে ভাবি। 

গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর এইজিং সাপোর্ট ফোরামের উদ্যোগে একটি ব্যক্তিক্রমী উদ্যোগের দেখা মিলেছে। রাজধানীর বারিধারা কনভেনশন সেন্টারে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় প্রবীণ ফ্যাশন শো। এতে মডেল হন ষাট থেকে নব্বই বয়সি মানুষেরা। র‍্যাম্পে তারা সেদিন হেঁটেছেন, ঠিক যেমন করে হাঁটেন নবীনরা। তুড়ি মেরে সেদিন তারা উড়িয়ে দিয়েছেন শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে মনের জড়তা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই বয়সও যে তারা মূল্যবান সেদিন এটাই প্রমাণ করেছেন। ছোট আয়োজন, কিন্তু যে বিশাল বার্তা তারা সেদিন ছড়িয়েছেন সমাজের কাছে, মানুষের কাছে। তা বহুদূরগামী। তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, প্রবীণরাও পারে, তাদেরও ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য আছে। সমাজে, পরিবারের আজ নতুন ভাবনার সময় এসেছে। পরিবারের যে সদস্যরা নিজেদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় পরিবারের পেছনে ব্যয় করেছেন, পরিবারের সদস্যদের টেনে নিয়েছেন, সময়ের চোরাস্রোতে তারা আজ ক্লান্ত, বোঝা টানতে টানতে তারা নিঃস্ব। কিন্তু এই নিঃস্ব, এই রিক্ততার পেছনের যে ইতিহাস তাকে মনে রেখেই পরিবারের নবীন সদস্যদের আজ নতুন চোখে দেখতে হবে বয়োজ্যেষ্ঠ স্বজনদের। ভুলে গেলে চলবে না, এই বয়োজ্যেষ্ঠ স্বজনরাও একদিন আমাদের মতোই ছিলেন। সেদিন তারা না থাকলে, তারা যদি আমাদের পেছনে নিজেদের সময়, অর্থ এবং ভালোবাসা ব্যয় না করতেন, তবে আজকের আমরা এখানে পৌঁছুতে পারতাম না। আজকে যারা নবীন, তাদের আজকের অবস্থানে থাকাটাও অসম্ভব হতো। প্রবীণ, সংসারের বয়োজ্যেষ্ঠদের যদি প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে আমরা ব্যর্থ হই, তবে আমাদের আগামীও হয়তো ম্লান হয়ে যাবে, পরের প্রজন্মের অবহেলা ও অনাদরে। আমাদের বেঁচেবর্তে থাকা, আমাদের আজকের জীবনের সোনালি সময়গুলোও অবহেলায় বিবর্ণ হয়ে যাবে। তাই বদলাতে হবে নিজের দৃষ্টিঙ্গি, তা হলেই বদলে যাবে সমাজ। সমাজ বদলে দেওয়ার জন্য আমার-আপনার ইচ্ছাটাই প্রধান। সেই শক্তিই পাল্টে দেবে, বদলে দেবে জীবনকে। অন্ধকার সরিয়ে নিয়ে যাবে ঝলমলে আলোর নিচে।

  • চেয়ারম্যান, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা