× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নতুন ভাইরাস

আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

ড. মুনীরউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৫৯ এএম

আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

চীনে নতুন মরণঘাতী এক ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে। হাসপাতালে রোগীর ভিড় ক্রমাগত বাড়ছে। ভাইরাসটি করোনাভাইরাসের মতো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দেওয়া ভাইরাসটির নামÑ দ্য হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি)। সাম্প্রতিক সময়ে যার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে চীন ও জাপানে। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসটির উপসর্গ মূলত ফ্লুর মতোই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশু ও বয়স্করা ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হচ্ছে। যাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা নাজুক, তারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়তে পারে। এটির সঙ্গে ইনফ্লুয়েঞ্জা এ, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া এবং এমনকি করোনাভাইরাস সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে শরীরে যেমন বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে তেমনি মৃত্যুও ঘটাতে পারে।

এইচএমপিভি ভাইরাস সম্পর্কে ৭ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে ‘প্রতিরোধ করা না গেলে মহামারির শঙ্কা’র কথা বলা হয়েছে। ভাইরাসটি নতুন করে আলোচনায় আসার কারণ, ইতোমধ্যে এটি একটু বড় পরিসরেই ছড়িয়েছে। চীন, জাপান, মালয়েশিয়ায় ভাইরাসটির দেখা মিলেছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও এর সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশেও ভাইরাসটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কারও কারও মাঝে আতঙ্কও ছড়াচ্ছে। তবে যেভাবে ভাইরাসটি নিয়ে আতঙ্ক এবং আলোচনা চলছে, তাতে করে সাধারণের মনে ধারণা জন্মাতে পারে এটি হয়তো নতুন বা এর প্রাণঘাতী ক্ষমতাও ভয়াবহ। তবে সাধারণের শঙ্কা দূর হওয়ার মতো আশাজাগানিয়া খবরও রয়েছে। এটি কোনো নতুন ভাইরাস নয়। এমনকি আমাদের দেশেও ভাইরাসটি নতুন নয়। আমাদের এখানে অনেক আগেই ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। তবে শঙ্কা নেই, এ কথায় আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকারও সুযোগ নেই। আমরা যদি প্রথমেই প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন না করি, সতর্ক না হই, যথাযথ প্রস্তুতি না রাখি, তবে তা বিপদ ডেকে আনতে পারে। মনে রাখতে হবে, যেকোনো ক্ষেত্রেই সচেতনতাই হলো প্রথম এবং উত্তম প্রতিরোধ ব্যবস্থা। 

প্রায় ছয় দশক আগে ভাইরাসটি শনাক্ত হয় এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটি সম্পর্কে চীনা বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, এইচএমপিভি নতুন হুমকি নয়। ভাইরাসটিকে সাধারণ ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করে চীনা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ভাইরোলজি ইনস্টিটিউটের গবেষক ঝেং লিশু বলেছেন, এইচএমপিভি ভাইরাস ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এটির সংক্রমণ বৃদ্ধির হার কম এবং অস্পষ্ট লক্ষণের কারণে বিজ্ঞানীরা প্রায় দুই দশক আগে প্রথমবারের মতো এইচএমপিভি ভাইরাস শনাক্ত করেন। চীনের বিশেষজ্ঞরা এই ভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা বা টিকা না থাকার কথাও উল্লেখ করেছেন। ইতোমধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ধাঁচের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ভাইরাসটি করোনার মতোই ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। তার পেছনে যে কারণটি রয়েছে, তা হলো চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা কয়েকটি ভিডিও। যাতে দেখা যায়, করোনার সময়ে হাসপাতালে যেভাবে ভিড় তৈরি হয়েছিল, একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এইচএমপিভির প্রাদুর্ভাবেও। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে জাপানেও। দেশটির সংবাদমাধ্যম বলছে, চলতি মৌসুমে দেশটিতে ঠান্ডাজনিত সংক্রমণ ছাড়িয়েছে সাত লাখেরও বেশি মানুষের মধ্যে। এ নিয়ে তারা সতর্কও করেছেন। তাদের অনেকেরই শঙ্কা, ২০২৫ সালে আবার করোনার মতো নতুন কোনো মহামারির উদ্ভব হতে পারে। যদিও কোন রোগটি মহামারি আকার ধারণ করবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা কেউ দিতে পারেননি। তবে বিশেষজ্ঞদের যে এইচএমপিভির প্রাদুর্ভাব ভাবাচ্ছে, তা নিশ্চিত। বিশেষজ্ঞদের এই ভাবনাই সাধারণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। করোনাকালে দুঃসহ স্মৃতি আমাদের রয়েছে। সেই দুর্বিষহ অব্স্থাকে মনে রেখেই ভয়। করোনার প্রথম, দ্বিতীয় ও ‍তৃতীয় ঢেউয়ের কথা এখনও দগদগে ক্ষত হয়ে রয়েছে বিশ্ববাসীর মনে। আমাদের দেশেও করোনা যেভাবে আঘাত হানে, জনজীবনে যে ব্যাপক ও বিরূপ প্রভাব ফেলে, তার রেশ এখনও কাটানো যায়নি। সেই সঙ্গে করোনার সংক্রমণ শুরুর আগে, বিশেষত বিশ্বজুড়ে যখন সতর্কবার্তা ঘোষিত হচ্ছিল, দেশে দেশে চলছিল লকডাউনের প্রস্তুতি, তার আগে-পরে আমাদের এখানে যেসব অসংগতি, ব্যর্থতা, সমন্বয়হীনতা দেখা গিয়েছিল, তাও ভুলে যাওয়া কঠিন। করোনা-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির দায়িত্বশীল ও জনস্বাস্থ্যবিদরা দেশে করোনা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির প্রেক্ষাপটে সারা দেশে যখন ‘শাটডাউন’-এর পরামর্শ দিয়েছিলেন তখন তা নিয়েও চলেছে নানান টালবাহানা। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে লকডাউন, কঠোর লকডাউনের মতো কর্মসূচিও নেওয়া হয়। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যে যে সময়ক্ষেপণের মনোভাব দেখা গিয়েছিল, যে অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বহীনতা দেখা গিয়েছিল, তা যে সর্বার্থে শুভ ফল বয়ে আনেনি সে তো তখনই স্পষ্ট হয়েছে। অতীতের সেই অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখেই আমাদের আগামী দিনের জন্য সতর্ক হতে হবে। তবে এইচএমপিভি করোনার মতো ভয়াবহ নয়, সেটিই স্বস্তির। করোনা থেকে বাঁচার জন্য যে স্বাস্থ্য নির্দেশিকাগুলো অনুসরণ করা হয়েছে এইচএমপিভির ক্ষেত্রেও সেগুলোর ওপরই বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে জোর দেওয়া হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির যত্নের ওপরও। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী চীনের বিশেষজ্ঞরাও রোগীর যত্নের ওপরই জোর দিয়েছেন। এইচএমপিভিতে আক্রান্ত রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, হালকা খাবার এবং উপযুক্ত পোশাক পরার কথা বলা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়া, পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা এবং জনাকীর্ণ স্থান এড়ানোরও পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। 

চীনে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়লেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এর উপস্থিতি শনাক্ত হয়নি। তবে যেহেতু এটি সংক্রামক রোগ এবং মানুষের মাধ্যমেই ছড়ায়, তাই সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। আর আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে যেহেতু ভাইরাসটির উপস্থিতি এরই মধ্যে শনাক্ত হয়েছে, আক্রান্ত রোগীরও দেখা মিলেছে, সেক্ষেত্রে বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, নৌবন্দরগুলোতে প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা

চীনে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়লেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এর উপস্থিতি শনাক্ত হয়নি। তবে যেহেতু এটি সংক্রামক রোগ এবং মানুষের মাধ্যমেই ছড়ায়। তাই সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। আর আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে যেহেতু ভাইরাসটির উপস্থিতি এরই মধ্যে শনাক্ত হয়েছে, আক্রান্ত রোগীরও দেখা মিলেছে, সেক্ষেত্রে বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, নৌবন্দরগুলোতে প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা। এজন্য বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তির প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ শনাক্ত রোগীকে প্রয়োজনে কোয়ারেনটাইনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। উপসর্গ সংবলিত ব্যক্তিকে দ্রুত শনাক্ত করে তার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাকে বাড়তি নজরদারিতে রাখতে হবে। এইচএমপিভি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া সাধারণ উপসর্গের মধ্যে রয়েছেÑ কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস। তীব্র অবস্থায় ব্রঙ্কাইটিস ও নিউমোনিয়া পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে। এই ভাইরাসের ইনকিউবেশন সময় তিন থেকে ছয় দিন। সংক্রমণের তীব্রতার ওপর নির্ভর করবে রোগের উপসর্গের স্থায়িত্ব। প্রায় দুই দশক আগে প্রথমবারের মতো এইচএমপিভি ভাইরাসের উপস্থিতি জানান দিলেও এখন পর্যন্ত এর টিকা আবিষ্কার হয়নি। প্রতিকার যেহেতু এখনও আবিষ্কার হয়নি, সেহেতু প্রতিরোধই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা। সেই প্রতিরোধের জন্য আপাতত আমাদের করণীয় কী? চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় যেসব সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল, একই পদক্ষেপে এই ভাইরাসও প্রতিরোধ করা সম্ভব। টানা ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া, অপরিষ্কার হাতে নাক-মুখ স্পর্শ না করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার মধ্য দিয়ে এইচএমপিভি থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব। এর সঙ্গে আমাদের শিশু, বৃদ্ধ, শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির রোগীদের ব্যাপারে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ঘন ঘন হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করার পাশাপাশি মাক্স না পরে বাইরে বা জনসমাগমে না যাওয়ার অভ্যাস আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এড়িয়ে চলতে হবে জনসমাবেশ বা ভিড়। সংক্রামক রোগ থেকে নিজকে রক্ষায় মনে রাখতে হবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়। তবে সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন প্রতিরোধ বা প্রতিকারে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট, ঠান্ডা জ্বর বা হাঁপানির মতো সমস্যা দেখা দিলে বাসায় অবস্থান করতে হবে। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়ার সঙ্গে সংক্রামক রোগে ভিটামিন সি ও ভিটামিন ডির ঘাটতি পূরণ করতে হবে। আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা। এইচএমপিভি ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। দরকার হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। সাধারণের সচেতনতার পাশাপাশি সরকারি পর্যায়েও নীতিনির্ধারকদের এখনই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হতে হবে। অবস্থা পর্যালোচনাপূর্বক প্রয়োজনে যেন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা থাকলে জনমনে আতঙ্ক ছড়াবে না। সচেতনতার মাধ্যমেই ভাইরাসকে প্রতিহত করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, আতঙ্ক নয়, দৃঢ় মনোবল নিয়েই রোগ মোকাবিলা করতে হয়।

  • শিক্ষাবিদ। জনস্বাস্থ্য ও ওষুধ বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা