সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৫৫ এএম
কোনো মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচানোর জরুরি সেবার নাম অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। অবশ্য এর আরও কিছু আভিধানিক নাম রয়েছেÑ ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল, তৃণমূল হাসপাতাল, রোগীর কাছে ছুটে যাওয়া খুদে হাসপাতাল ইত্যাদি। যে নামেই ডাকা হোক না কেন এই সেবার ক্ষেত্রটিতে যা চলছে তা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। ৬ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘আ্যম্বুলেন্সেও ভেজাল’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই জরুরি সেবার নানা অনিয়ম ও নৈরাজ্যকর চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে যেসব অ্যাম্বুলেন্স পথে-ঘাটে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় সেগুলোর অধিকাংশ অ্যাম্বুলেন্স নয়। এগুলোর বেশিরভাগ মাইক্রোবাস কেটে বানানো। ভেতরে লক্কড়ঝক্কড় একটি ট্রলি ছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম বলতে তেমন কিছুই থাকে না। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে বহনকারী এসব অ্যাম্বুলেন্স নিজেই একেকটা মৃত্যুপথযাত্রী রোগী। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে পেশিশক্তির ব্যবহার, রাজনৈতিক পরিচয়, বিআরটিএ এবং পুলিশকে ম্যানেজ করে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট সেবার নামে এই বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সে জরুরি চিকিৎসা সহায়তাকারী থাকার কথা হলেও বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে প্রায় ৯ হাজার অ্যাম্বুলেন্স আছে। এর একটা বড় অংশই রূপান্তরিত। সিংহভাগ অ্যাম্বুলেন্সই শর্ত পূরণ করেনি। আর এসব অ্যাম্বুলেন্সের অধিকাংশই ব্যক্তিমালিকানার। এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছে মাইক্রোবাস কেটে বানানো যানগুলো। এই নিবন্ধন পাওয়ার ব্যাপারে বিআরটিএর প্রচলিত আইন মানা হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই নামকাওয়াস্তে একটি রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার, রূপান্তরিত সব অ্যাম্বুলেন্সই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত। বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতিও স্বীকার করছে, মাইক্রোবাস কেটে অ্যাম্বুলেন্স তৈরির কথা। অবশ্য তাদের দাবি, সেগুলো এখন ঢাকায় চলাচল করে না। চলে ঢাকার বাইরে। ঢাকার ভেতরে চলাচলকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলো অ্যাম্বুলেন্স হিসেবেই ইম্পোর্ট করা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বিআরটিএর কিছু অসৎ কর্মকর্তার পরোক্ষ মদদে এগুলো অবাধে সর্বত্র চলাচল করছে। কোনো মনিটরিং নেই। অথচ আইন বলছে, বিআরটিএর অনুমতি ছাড়া যেখানে একটি গাড়ির বাইরের রঙ পরিবর্তন করাটাই নিষিদ্ধ, সেখানে মাইক্রোবাসের পুরো অবয়ব পাল্টে তৈরি করা হচ্ছে এই বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স। জাল কাগজপত্র দিয়ে নেওয়া হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন। আমরা মনে করি, কিছু অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার জন্য সরকারের সেবামূলক এই সংস্থাটির সুনাম ক্ষুণ্ন হোক তা কাম্য হতে পারে না। অবিলম্বে এই চক্রটি চিহ্নিত করা জরুরি। সময় এসেছে বেআইনিভাবে এবং শর্ত ভঙ্গ করে চলা এই ‘ব্যবসা’কে সেবাধর্মী ও বিধিবদ্ধ করার।
ভুলে যাওয়া চলবে না, মুমূর্ষু রোগী আর অ্যাম্বুলেন্স সমার্থক বিষয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত রোগীকে সাময়িক কিছু চিকিৎসাসেবা দেওয়ার দায়িত্বও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর বর্তায়। একটি ভালোমানের অ্যাম্বুলেন্সে থাকবে প্রাথমিকভাবে আইসিইউর প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা উপকরণ। অবশ্য ঢাকায় গুটিকয়েক উন্নতমানের অ্যাম্বুলেন্সে প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থাকলেও সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে ডাক্তার না হোক একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভালো মেডিকেল অ্যাটেনডেন্ট থাকা প্রয়োজন। আর এসব সুবিধা থাকলেই একজন মুমূর্ষু রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে আনার সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু এসবের কিছুই নেই। অ্যাম্বুলেন্সে জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম যথাÑ অক্সিজেন সিলিন্ডার ও মাস্ক, স্ট্রেচার, রোগীর শয্যা ও চিকিৎসকের বসবার আসন ইত্যাদি থাকার কথা। মাইক্রোবাসের ভেতরের আসনবিন্যাস সামান্য অদল-বদল করে, গাড়ির ওপর সাইরেন লাগিয়ে দিলেই তাকে অ্যাম্বুলেন্স বলা যাবে না।
নিকট অতীতে ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে বেপরোয়া চালকের অ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এসব দুর্ঘটনার দায় এড়াতে অ্যাম্বুলেন্সচালক ও মালিকরা ধর্মঘট করে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। আরও রয়েছে রোগী কিংবা লাশ পরিবহনে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়ের অভিযোগ। আমরা মনে করি, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসকে জরুরি সরকারি সেবা হিসেবে সহজলভ্য করতে হবে। বিদ্যমান অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসাকে প্রচলিত আইনের অধীনে রোগীবান্ধব, জবাবদিহিমূলক এবং সাশ্রয়ী করায় পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্দিষ্ট ভাড়ায় রোগী অথবা লাশ গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সে আবশ্যকীয় সব আয়োজন থাকা নিশ্চিত না করে, কাউকেই এর লাইসেন্স দেওয়া ঠিক হবে না। অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও অসুবিধা দূর করে একটি আধুনিক, মানসম্মত ও সেবাধর্মী অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস প্রচলনের লক্ষ্যে ‘অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস নীতিমালা’ তৈরির কথা অতীতে শোনা গেলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এই সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করে ‘কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করা হোক। যেকোনো মূল্যে সেবার নামে নৈরাজ্য বন্ধ করতেই হবে।