গণপরিবহন
ড. মো. হাদিউজ্জামান
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৫৩ এএম
সম্প্রতি দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন শহর কক্সবাজারে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হয়েছে ‘অনলাইন বাস টার্মিনাল’। এ সেবার আওতায় ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা রোধ এবং যাত্রী ও পর্যটকের ভোগান্তি লাঘব হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ৫ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, অনলাইন বাস টার্মিনাল চালু হওয়ার পর সেখানে যানজট কমতে শুরু করেছে। আধুনিক বাস ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে এমন একটি উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে কক্সবাজারে যেভাবে তা বাস্তবায়িত হয়েছে, রাজধানীতে বাস্তবায়ন করা কঠিন। কিন্তু যেহেতু দেশের একটি জায়গায় এমন উদ্যোগ নেওয়া গেছে, তার মানে আঞ্চলিক রূপ বিবেচনা করে সারা দেশেই নানাভাবে এমন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব। দেশের সড়ক অবকাঠামোর উন্নতি ঘটলেও সড়ক ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকায় রাজধানী ঢাকা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামে যানজট লেগেই থাকে। প্রতিনিয়ত কর্মঘণ্টার অপচয় ঘটতেই থাকে। আমরা দেখছি, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা যেমন অনিশ্চিত তেমন যাত্রীদের ভোগান্তিও চরমে। বিশেষত ওয়েবিল পদ্ধতি উঠে যাওয়ার পর থেকে বাসগুলো সেমিলোকাল পদ্ধতিতে যাত্রী আনা-নেওয়া করে। যেহেতু নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ নেই তাই সড়কে যানজট লেগেই থাকছে। আর সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার অভাবে বাসচালকদের মধ্যে বেপরোয়ানাও লক্ষণীয়। এর মূল কারণ বাসচালকরা মালিকদের টাকা পরিশোধ করেন ট্রিপের ভিত্তিতে। তা ছাড়া দেশে গণপরিবহনে পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রেও এক ধরনের বৈষম্যমূলক কাঠামো রয়েছে। সমস্যা হলো, এ বৈষম্যমূলক পরিবেশ জিইয়ে রাখার পেছনে দায়ী এ খাতের বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা। কারণ ড্রাইভার কিংবা বাসের কন্ডাক্টর কাউকেই যোগ্যতা প্রমাণ করে এ পেশায় আসতে হয় না। এখন গণপরিবহনে চালক ও তার সহযোগীদের দিনের টার্গেট পূরণ করতে হয় এবং তারপর তিনি পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক নিয়ে ফিরতে পারেন। আর এ পারিশ্রমিক অর্জনের জন্য তার শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য নিয়েও ভাবার সুযোগ থাকে না।
আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি গণপরিবহনে যাত্রী ও চালকের সহযোগীর দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করছে। সড়কে এমন ঝগড়া-বিবাদ অনেক সময় ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যাত্রীরা অনেক সময় ড্রাইভারের সঙ্গে গাড়ি চলা অবস্থায় বচসায় লিপ্ত হয়। আবার ট্রিপের কোঠা পূরণ করতে গিয়ে সড়কে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে থাকা বাসগুলো দুর্ঘটনা ঘটায়; যা অনেক সময় সড়কে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। দেশে চালকদের বিশ্রামের ব্যাপারটাও উপেক্ষা করা হয়। যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টাও হালকাভাবে নেওয়া হয়। ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য সড়কে যে লেন থাকার কথা, তা নেই। হালকা যানবাহনগুলো অনেক সময় বারবার ওভারটেকের চেষ্টা করে। কিছু অসাধু পরিবহন ব্যবসায়ী ভাড়া-নৈরাজ্য শুরু করে দেন। লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো সংস্কার ও রঙচঙ করে মহাসড়কে দূরপাল্লার যাত্রায় নামিয়ে দেন। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেন। আনফিট গাড়ির চালক যারা, তারা নিজেরাও আনফিট। একজন চালক যদি দক্ষ, অভিজ্ঞ হন তিনি কখনোই একটি আনফিট গাড়ি নিয়ে সড়কে নামবেন না। আনফিট গাড়ি ফিট যানবাহনগুলোকেও ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। মোটরসাইকেলকেও আজ যেন আমরা মিনি গণপরিবহনে পরিণত করেছি। মোটরসাইকেলের চালকদের দূরপাল্লায় চালানোর মতো অভিক্ষতা, দক্ষতা ও শারীরিক ফিটনেস না থাকায় নিয়মিত দুর্ঘটনা বাড়ছে।
বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে পাইকারিভাবে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। বহু মালিক আছেন, যারা ফিটনেস সনদ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেন না। এমনকি ২০১০ সালে একবার ১০ বছর ধরে যেসব যানবাহন ফিটনেস সনদ নেয়নি, সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে। এরপর সরকার জরিমানা দিয়ে এবং যথাযথ ফি দিয়ে ফিটনেস সনদ নেওয়ার জন্য বলেছিল। কিন্তু সেখান থেকেও পিছু হটে বলা হলো, জরিমানা দেওয়ারও দরকার নেই, শুধু ফি দিয়ে ফিটনেস সনদ নিন। এর পরও বিপুলসংখ্যক মালিক ফিটনেস সনদ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে জননিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে সড়ক-মহাসড়কেও। সড়কে বিশৃঙ্খলা, ট্রাফিক পুলিশের অপর্যাপ্ততা এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যানজট নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে; যার সমাধান জরুরি। নীতিনির্ধারকরা যখন গণপরিবহনের ক্ষেত্রে আইন শিথিল করেন তখন মূলত বিজ্ঞানের সঙ্গে আপস করতে হয়। আর এ ধরনের আপস অনেক ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে ঝুঁকিই বাড়ায়। অভিযোগ রয়েছে, সড়ক ব্যবস্থাপনায় যে আইন রয়েছে তা সমঝোতা কিংবা আপসের দলিল। বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে পড়ে অথবা অনেক সময় সংকটের কথা বলে এ ক্ষেত্রে একটা আপসের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, এমনও বলা হয়। আসলে আমাদের সড়ক অবকাঠামো চওড়া হচ্ছে, আধুনিক হচ্ছে, কিন্তু পাল্লা দিয়ে পরিবহন, চালক ও আইন যেমনটা স্মার্ট হওয়ার কথা, সেটা হয়নি।
সড়ক দুর্ঘটনায় যারা হতাহত হচ্ছে, তাদের বড় একটা অংশের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। তাদের ড্রাইভিং সনদ থাকার প্রশ্নই আসে না। আমাদের উঠতি বয়সি কিশোর-তরুণরা নজরদারির অভাবে ও অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে মোটরসাইকেল নিয়ে সড়ক-মহাসড়ককে রেসিং ট্র্যাক বানিয়ে প্রতিযোগিতা করছে। যাতে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে, অকালে অনেকের প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। এসব কিশোর-তরুণের পছন্দের শীর্ষে থাকছে স্পোর্টিং ও উচ্চগতির মোটরসাইকেল। অথচ আমাদের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সিসির সঙ্গে গতির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা অনেকটাই কল্পনাপ্রসূত কথাবার্তা। আমাদের সড়কে যেখানে শৃঙ্খলার কোনো বালাই নেই; সেখানে বলা হচ্ছে, সিসির সঙ্গে গতির কোনো সম্পর্ক নেই! এ ধরনের হায়ার সিসি মোটরসাইকেলে যখন কিশোর-তরুণরা বসবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই উচ্চগতি তাদের প্রলোভিত করবে।
সড়ক ব্যবস্থাপনায় নীতিগুলো নিচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এ ক্ষেত্রে বড় একটা বিষয়। এটা সত্যি এ সমন্বয়ের বিষয়টি জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। আমাদের সড়ক বিভাগ সড়ক তৈরি করছে যানবাহনের গতি বাড়ানোর জন্য। সেখানে ভারী যানবাহন চলবে। আবার শিল্প মন্ত্রণালয় মোটরসাইকেল দিয়ে শিল্প বিকাশের কথা বলছে। তাহলে দুর্ঘটনার দায় কার? সমস্যা হলো, আমাদের পরিবহন মালিকরা পরিবহনের ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন। ঝুঁকি উপলব্ধির বোধ তাদের অনেকেরই খুবই দুর্বল। আনফিট গাড়ি, আনফিট চালক, অনিবন্ধিত চালক, অবৈধ যানবাহন যখন সড়কে চলছে, এটার যে প্রতিঘাত, সেটা তারা মোটেই আমলে নেন না। পাশাপাশি মালিকদের মানানোর জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার দরকার, সেখানে ঘাটতি আছে।
মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো অত্যাধুনিক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। তবে আমাদের ট্রাফিকব্যবস্থা এখনও সেকেলে রয়ে গেছে। আমরা আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কেন যেতে পারছি না, এর অন্তর্নিহিত কারণও রাজনৈতিক। এ ঢাকা শহরের সড়কে এখনও প্রায় ১৮ সংস্করণের যানবাহন চলছে। রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ছোট-বড়, হালকা-ভারী, দ্রুতগতিÑ সব যান একসঙ্গে চলছে। সড়কে গতিসীমা নির্ধারণ করে যেসব যানবাহন এ গতিসীমায় চালাতে সক্ষম, সেগুলো রেখে ট্রাফিক সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় এনে একটা চমৎকার ও আধুনিক সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারি। আলাদা লেন থাকলে সময়সূচি ধরে ধরে গণপরিবহন চলার যে দর্শন, সেটা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো। বাসগুলো একটা কোম্পানি বা ছাতার নিচে এনে গণপরিবহনগুলো একটা চমৎকার শৃঙ্খলা ও লাভজনক করা সম্ভব। ঢাকার পরিবহন মালিক প্রায় ৩ হাজার। বিশ্বের কোনো শহরেই সম্ভবত এত বিপুলসংখ্যক মালিকের নজির নেই। এর মানে আমরা রুট পারমিট দিয়েছি অবৈজ্ঞানিকভাবে। যারা পরিবহন নেতা আছেন, তাদের কাছে রুট পারমিট পাওয়া মানে বিশাল ব্যবসা। একেবারে বিনিয়োগ ছাড়া মুনাফার সুযোগ। ঢাকা শহরে ৪০ থেকে ৪২টির বেশি রুট দরকার নেই। কোনো একটি রুটে দেখা যায় অনেক পরিবহন চলছে, আবার একই পরিবহনের মধ্যে অনেক মালিক আছেন। ঢাকার বাসে বাসে রেষারেষি কিন্তু এ কারণেই হয়। সরকারের কাজ রুটগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি করে দেওয়া, অবকাঠামোগুলো তৈরি করে দেওয়া। মেট্রোর মতো আধুনিক যান যেখানে এসেছে, আমি মনে করি আমাদের সময় এসেছে শুধু বাসমালিকদের দিকে না তাকিয়ে, প্রয়োজনবোধে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা। প্রয়োজনে বাইরের অপারেটরদের, যাদের বড় শহরে গণপরিবহন পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে, তাদের আসার সুযোগ করে দেওয়া। এখানে নীতি দরকার, রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার, যারা অপারেটর আসবে, তাদের সমর্থন দেওয়া দরকার।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কিংবা পরীক্ষানিরীক্ষা করে যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে কি না, কেন অনেক মালিকই ফিটনেস সনদ নিতে অনুৎসাহিত হচ্ছেন, সে দায় কিন্তু কেউ নিচ্ছে না। দক্ষ চালক তৈরির জন্য যেভাবে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা নেওয়ার কথা তা কিন্তু হচ্ছে না, তার জবাবদিহিও কেউ করছে না! এমনকি মহাসড়কগুলোয় ধীরগতির যান চলার কথা নয়, কিন্তু ম্যানেজ করে সেগুলোও চলছে। যাদের ম্যানেজ করে সেগুলো চলছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে, দায় নেওয়ার মানে হলো পরাজিত হওয়া। এ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।