শিক্ষাঙ্গন
কাজী লতিফুর রেজা
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৫১ এএম
কাজী লতিফুর রেজা
কলিং বেলের শব্দ শুনে মিরাভ ছুটে আসে। দরজাটা খুলতেই জড়িয়ে ধরে। পাপা বই দিয়েছে। নতুন বই। ওর মুখটা ঝলমল করছে। ব্যাগের ভেতর থেকে বইগুলো বের করে টেবিলের ওপর রেখে মিরাভ বলল, ‘পাপা, বইয়ে কভার দিয়ে দাও।’ মিরাভের মুখের দিকে তাকিয়ে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। আমরাও বাবার অপেক্ষায় থাকতাম, কখন বাবা আসবে অফিস থেকে। বাবা বাসায় আসবার পরেই তিন ভাই-বোন ছুটে যেয়ে বইগুলো দেখাতাম। একসঙ্গে অনেক বই, সে কী আনন্দ।
প্রতিবারের মতো আমার ছেলে এ বছরও অপেক্ষা করছে নতুন বইয়ের জন্য। তার নতুন স্কুল, নতুন ক্লাস। বারবার জিজ্ঞাসা করছে, পাপা, বই কবে পাব? তার জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে ফিরি। আমরা বাবা-মায়েরাও অপেক্ষায় আছি। দেশের কোটি মিরাভরা অপেক্ষায় আছে। তারা অপেক্ষায় ছিল বই উৎসবের। বছরের শুরুতেই নতুন বই শিশুর মনে নিয়ে আসে বাঁধভাঙা আনন্দ। যদিও এবারে বই উৎসব হয়নি। শিশুরা সারা দেশে একযোগে বই পায়নি।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্য বই প্রদানের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বছরের প্রথম দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তক প্রায় সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো পরিণত হয়েছিল একটি অলিখিত রীতিতে। দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয় বিনামূল্যে পাঠ্য বই বিতরণের এমন উদ্যোগ। শিক্ষার্থীরাও অপেক্ষা করে বছরের প্রথম দিনে বই হাতে পাওয়ার। উৎসবের আমেজেই তারা বই গ্রহণ করে। আনন্দে উদ্বেলিত শিশুর মুখ অভিভাবকদেরও আনন্দিত করে। অনেক অভিভাবকই বছরের প্রথম দিন সন্তানকে নতুন বই কিনে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন না। বিনামূল্যে বই পাওয়ার মাধ্যমে তাদের সেই কষ্টেরও অবসান হয়। তবে এবারে বই উৎসব না হওয়ায়, বছরের প্রথম দিনে বই হাতে না পাওয়ায় শিশুদের ম্লান মুখের ছবি দেখতে হয়। গত ২৯ ডিসেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘পাঠ্য বই এবার ভোগাবে’ শীর্ষক শিরোনামের প্রতিবেদনেও শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, বছরের প্রথম দিন তো দূরের কথা, মার্চেও শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মন থেকে অনিশ্চয়তার মেঘ সরাতে পারেনি। যদিও প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ শেষের পথে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, মাধ্যমিকের অনেক বই ছাপানোর কাজ এখনও শুরুই হয়নি। মাধ্যমিকের বই ছাপার কাজ শুরু না হওয়ার কারণেই মূলত শিক্ষার্থীদের হাতে একযোগে বছরের প্রথম দিন বই তুলে দেওয়ার ঐতিহ্য রক্ষা করা যায়নি। শিক্ষার্থীরা বই না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছে বিষণ্ন মনে। ‘প্রথম দিনে বই না পেলেও চলতি মাসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের কাছে সব বই পৌঁছে দেওয়া হবে’Ñ এনসিটিবির এমন বক্তব্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্বেগ দূর করতে যথেষ্ট হলেও সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়ায় প্রকাশকরা ভিন্ন মত প্রকাশ করছেন। তাদের মতে, চলতি মাস তো দূরের কথা, মার্চের শেষার্ধের আগে সব বই পাওয়া সম্ভব হবে না। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি এনসিটিবি বাস্তবতা আড়াল করে সমস্যাটিকে আরও গভীর করছে? যথাসময়ে বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা শুধু বিষণ্নই হয়নি, তাদের পাঠ্যাভ্যাসেও বিশৃঙ্খলা এবং অমনোযোগিতা সৃষ্টি হবে। যা শিক্ষার প্রতি আগ্রহের অভাব ও গুরুত্বহীনতার অনুভূতি তৈরি করতে পারে। আর এই পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের জন্য ফেলতে পারে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব। আমাদের মনে রাখতে হবে, বই বিতরণ যত দেরি হবে, শিক্ষার্থীদের তত বেশি ক্ষতি হবে। তবে আশার কথা, বছরের প্রথম দিন সব বই দিতে না পারলেও এনসিটিবির পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বই দেওয়ার চেষ্টা এবং বইয়ের মান নিয়ে আপস না করার যে বার্তা সংবাদমাধ্যমে আসছে, তা ইতিবাচক। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও বিতরণ করে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেওয়াকে সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমরা সরকারের অগ্রাধিকার, এনসিটিবির আশাবাদ এবং আপস না করার প্রসঙ্গে আস্থা রাখতে চাই।
বলা হচ্ছে, এবারে শিক্ষাক্রম আগে নাকি পাঠ্যপুস্তক, সেটি ঠিক করতেই সময়ক্ষেপণ হয়েছে। শিক্ষাক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও আমরা ফিরে গেছি ২০১২ সালের কারিকুলামে। প্রচলিত কারিকুলামের ত্রুটি নির্ধারণ না করে বাতিলের চিন্তা কতটা বুদ্ধিপ্রসূত, তাও কিন্তু ভাববার বিষয়। সৃজনশীল পদ্ধতি কেন কার্যকর করা যাচ্ছে না বা কার্যকরে বাধা কোথায়, তা নির্ধারণ না করেই বাতিলের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললে ভুল হবে কি না সেটিও ভাবা প্রয়োজন।
আমরা চাই, সমস্যার দ্রুত সুরাহা হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই আসুক। এক্ষেত্রে আমরা যদি পরিবর্তন আনতে চাইÑ অনিয়ম, দুর্নীতি, বৈষম্য নিরসন চাই, তবে এনসিটিবিকে দক্ষ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে হবে। মুদ্রণ সংশ্লিষ্ট সকল সিন্ডিকেট, মুদ্রণ চুক্তির জটিলতা এবং সমন্বয়ের অভাব বই প্রাপ্তির সমস্যাকে বাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে সংকটের কারণগুলো চিহ্নিত হয়েছে। তবে তা যথেষ্ট নয়, বরং এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা। যাতে এনসিটিবির মুদ্রণ কার্যক্রমের দ্রুততা নিশ্চিত হয়। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে দরপত্র প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার বিষয়েও জোর দেওয়া দরকার। মুদ্রণ সংশ্লিষ্ট সকল সরবরাহ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি সিন্ডিকেট ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে হবে।
আগামী দিনের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কারিকুলাম প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের মতামতের সঙ্গে শিক্ষাবিদ ও সাধারণ মানুষের পরামর্শ বিবেচনায় নিতে হবে। বিতর্ক এড়াতে স্বচ্ছ এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু সুষ্ঠু পরিকল্পনা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং তীক্ষ্ণ তত্ত্বাবধানের মাধ্যমেই আবার আগামী বছরের শুরুতে মিরাভদের মতো কোটি শিক্ষার্থীর কাছে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিশ্চিত হতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা আগামীতে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিন নতুন বই তুলে দেওয়ার উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। এজন্য প্রথম থেকেই বই প্রকাশের জন্য দেশে কাগজ তৈরির পর্যাপ্ত মণ্ড মজুদ করা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট দূর করা, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাসহ আনুষঙ্গিক সকল কাজ যথাসময়ে করা জরুরি। বই প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কারও বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে এবং কারও অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা যথাসময়ে বই ছাপার কাজ সম্পন্ন না হলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রত্যাশা, আগামীতে সকল প্রতিকূলতা এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করে সরকার বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে সক্ষম হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একযোগে এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেওয়া এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ ছাড়া এবারের প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দায়িত্বগ্রহণকারী অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেভাবে শিক্ষা ক্যারিকুলামের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের কাজটি সম্পন্ন করে বই প্রকাশের দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতার ছাপ রেখেছে, তাও আগামী দিনের প্রেরণা। এত বিপুল কর্মযজ্ঞে কিছু ভুলত্রুটি থাকতেই পারে, দেখা দিতে পারে বিপত্তিও। তবে কারও ব্যক্তিগত গাফলতি ও দুর্নীতির কারণে এমন কর্মযজ্ঞ প্রশ্নবিদ্ধ হলে, কোনোভাবেই সেই মুষ্টিমেয় লোকের ব্যর্থতা, দুর্নীতিতে ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। সেই সঙ্গে লক্ষ রাখা জরুরি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন শুধু শিক্ষার্থীদের শৈশবের আনন্দই নিশ্চিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন শিশুদের আগামী দিনের সোনালি ভবিষ্যৎ নির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।