যুক্তরাষ্ট্র
আরওয়া মাহদী
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:১৭ এএম
আরওয়া মাহদী
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে ছিল ঝকঝকে রোদ। সুন্দর এ দিনটিতে ওয়াশিংটনে দেশটির গণতন্ত্রের মুক্তির উদ্দেশ্যে অনেকে জড়ো হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতে, ওইদিন কেউ কোনো ভুল করেনি। গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গার ঘটনা সম্ভবত এখন অনেকের মনেই আর তাজা নেই। কীভাবে জিঘাংসাতাড়িত মব সুন্দর দিনটি নষ্ট করেছে, তা দেখা গেছে সেদিন। অন্তত ১৪০ জন পুলিশকে নির্যাতনের শিকার হতে হয় এবং চারজন নিহত হন। অথচ এ ঘটনাটিকে এখনও অল্পসংখ্যক মানুষ গুরুত্বসহকারে বিচার করেন। ওয়াশিংটন পোস্টের বরাতে ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের এক পোলের জরিপে বলা হয়, প্রতি ১০ রিপাবলিকানের মধ্যে অন্তত সাতজন মনে করেন, ক্যাপিটল হিল দাঙ্গা নিয়ে অতিরিক্ত আলোচনা করা হয় এবং ওই ঘটনাটি এত জটিল কিছু না। তাদের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অবান্তর হয়ে উঠেছে। অন্য কয়েকটি জরিপে এও দেখা গেছে, রিপাবলিকানরা ক্রমেই এ দাঙ্গা সম্পর্কে বলা ঘটনার সত্যতার প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছেন। এ ঘটনার জন্য ট্রাম্প দায়ীÑ এ কথাটিও তারা মেনে নিতে পারছেন না। বরং তারা এ ঘটনাকে একটি সফল আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে থাকেন।
স্পষ্ট হতে গেলে বলতে হবে, চার বছর আগে ৬ জানুয়ারি একটি ক্যু পরিচালিত হয়। তবে এমন একটি ঘটনার হোতা হওয়ার পরও ট্রাম্পকে সরাসরি কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। দাঙ্গার ওপরই আমাদের অনেক মনোযোগ দেওয়া জরুরি। কারণ দাঙ্গার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও অদ্ভুত একটি ঘটনা। ৬ জানুয়ারির পোস্টারবয়দের মধ্যে প্রধান জ্যাকব চ্যানসি, একেএ ক্যানন শামান যারা যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট চেম্বার স্পোর্টিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। অন্তত তাদের আচরণে মনে হয়েছে এটি একটি ক্যু। আবার এ ঘটনাকে ক্যুও বলা যাবে না। ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবেই এটিকে দেখতে হবে। তার সহযোগিতা ২০২০ সালের পর থেকেই ভুল তথ্য, অন্যদের খোঁচা দেওয়া, মানুষকে হেয় করা এমনকি অসংখ্য জায়গায় নিজস্ব প্রচার ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। ক্যাপিটল হিল দাঙ্গাও তাদের বিরাট পরিকল্পনার অংশ যা সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে।
অনেকে যুক্তি উপস্থাপন করেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনেই ক্যুয়ের বীজ বপন করা হয়। ওই সময় ট্রাম্পকে অন্তত ১০ লাখ মানুষ (ভিত্তিহীন) অবৈধভাবে ভোট দিয়েছে। নির্বাচনে জালিয়াতির বিষয়ে পরবর্তী সময়ে ট্রাম্প সোচ্চার থেকেছেন। আর এভাবেই ট্রাম্প তার ভক্তদের মনে এমন ধারণা গেঁথে দেন, তাকে দমানোর জন্য সব ধরনের অবৈধ পন্থাই অনুসরণ করা হচ্ছে। ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের পর আবারও ট্রাম্প ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলেন এবং জানান তার ভোট চুরি হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড় সংকট দেখা দেয়। তবে ট্রাম্পের নকল নির্বাচকদের কৌশল আস্তে আস্তে সবার সামনে উন্মোচিত হয়। ২০২০ সালের নির্বাচনের পর ৮৪ জনের একটি গ্রুপ জো বাইডেনের জয় হওয়া সাতটি স্টেটের ফলকে ভিত্তিহীন দাবি করে। এ ধরনের ধারণা ৬ জানুয়ারি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে ধারণা তৈরি করে তা জো বাইডেনের জয়কে নানাভাবেই ম্লান করে দেয়। এমনকি বাইডেনকে সরাসরি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রেও বড় বাধা দেয়। ট্রাম্প সমাজমাধ্যমেও প্রচার চালিয়ে যান।
ট্রাম্পের এ দাঙ্গার ফলে ভোটের পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়েছে। ট্রাম্প ওইদিনই তার ক্যু পরিচালনা করেননি। সেদিন রাত ৮টার দিকেও ক্যাপিটল হিল যথেষ্ট শান্ত এলাকা ছিল। দীর্ঘ চার বছর পরও ট্রাম্পের এ কৌশলের জন্য রাজনৈতিকভাবে তিনি বড় ক্ষতির মুখোমুখি হননি। তিনি অনেকটা বহাল তবিয়তেই আছেন। বরং তিনি এখন ইলেকটোরাল কলেজের বৈধ ও নির্বাচিত প্রার্থী। অন্যদিকে দাঙ্গায় অংশ নেওয়া ১ হাজার ৪০০ মানুষের ওপর ফৌজদারি, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রবিদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। যাদেরকে ট্রাম্প দেশপ্রেমী এবং সত্যিকারের শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অনেকেই এখন প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমার অপেক্ষায় রয়েছেন। ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পরই তারা মুক্ত হবেন। অতীতের ওই ঘটনা যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির জন্য বাজে অধ্যায়, তা তারা মেনে নেবেন না। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারেও ট্রাম্পের রানিংমেট জেডি ভান্স এ ঘটনাকে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতোই বিচার করেছেন। এমনকি তাদের মিথ্যাচারের বিষয়টি নিয়েও বড় করে আলোচনা করেননি। দাঙ্গার পরবর্তী সময় একটি অংশ মিডিয়াকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছে। তবে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম এ সমাবেশকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বলে মেনে নিতে পারেনি। তবে ট্রাম্পের সমর্থকরা নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্বের আলাপ দিয়েছেন এবং এগুলোই মূলত সাধারণ মানুষের মনে থিতু হয়েছে।
মেনে নিতে হবে, ট্রাম্প অনন্য রাজনৈতিক প্রতিভা। একজন মানুষের এতটা নির্লজ্জ হওয়া একটি সুপারপাওয়ারের মতো। নৈতিকভাবে সিদ্ধ নয় এমন অনেক ঘটনা থেকে তিনি সহজেই পার পেয়ে গেছেন। অনেক রাজনীতিবিদ যুক্তরাষ্ট্রে এমন দাঙ্গা উৎসাহ দিয়ে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধরে রাখতে পারতেন কি না, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রতিভার নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া এবং বর্তমান অবকাঠামোগত সমস্যার ওপর নির্ভর করছে। আমরা একই বিশ্বের নাগরিক হিসেবে সব সময় সংযুক্ত থাকার আত্মশ্লাঘা বোধ করি। এ আত্মশ্লাঘা থেকে বেরিয়ে বুঝতে হবে, নানা জায়গায় মিথ্যা অপপ্রচার সম্ভব। চার বছর হয়ে গেছে। ক্যাপিটল দাঙ্গার ঘটনা আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। তবে বিষয়টিকে ইতিহাসের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। বরং এ ঘটনাকে ভবিষ্যতের জন্য বড় অশনিসংকেত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ : আবেদিন আকাশ