স্মরণ
বনশ্রী ডলি
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:১০ পিএম
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। সমাজের নিচুতলার নিষ্পেষিত মানুষের শ্রেণিসংগ্রাম উঠে এসেছে তার লেখনীতে। বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তার সাহিত্যকর্মের অন্যতম উপাদান। খুব কমই লিখতেন তিনি। দুটি উপন্যাস, পাঁচটি গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ সংকলন এই নিয়ে তার রচনাসম্ভার। কিন্তু যা লিখতেন তার সাহিত্যমান তাকে বাংলা সাহিত্যে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। পাঠককে তিনি নিয়ে গেছেন ব্যক্তিসত্তার অতল গভীরে। সাহিত্যবোদ্ধাদের মূল্যায়নে তাকে সমাজবাস্তবতার অনন্য রূপকার বলা হয়। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পরেই তিনি পাঠকপ্রশংসিত লেখক। তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলিÑ উপন্যাস : চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা। এ দুটি উপন্যাসকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের এপিক। বয়ানভঙ্গি, চরিত্রচিত্রণ, সমকালকে জীবন্ত করে তোলার বৈশিষ্ট্য নিয়ে এ উপন্যাস দুটি বাংলা সাহিত্যে আলাদা সাহিত্যরসের সন্ধান দিয়েছে। ছোটগল্প সংকলন : অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উৎপাত, দোজখের ওম, জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল। প্রবন্ধ সংকলন : সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কিছু কাজ অন্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও। তার সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, ‘কী পশ্চিম বাংলা, কী বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।’ তার কাজ সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘ইলিয়াসের উপন্যাস প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বমানের, নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন যেসব কথাসাহিত্যিক, তিনি ছিলেন সেই মাপের লেখক।’
পুরো নাম আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস। ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে তার জন্ম। পৈতৃকনিবাস বগুড়ায়। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় বগুড়ায়। ১৯৫৮ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্মাতকোত্তর লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে। পরে তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপপরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশে নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন। গোপনে এবং প্রকাশ্যে তাদের সঙ্গে সহযোগিতাসহ যোগাযোগ রাখেন। তার লেখা প্রতিশোধ, অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, মিলির হাতে স্টেনগান, অপঘাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, রেইনকোট প্রভৃতি গল্পে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছেন।
কর্মময় জীবনের মূল্যায়নে তিনি একুশে পদক (মরণোত্তর), বাংলা একাডেমি পুরস্কার, হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার, কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ঘাতকব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।