× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

দূষণ

শব্দের অত্যাচারে নিঃশব্দ ক্ষতি

মো. অহিদুর রহমান

প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৫৫ পিএম

শব্দের অত্যাচারে নিঃশব্দ ক্ষতি

প্রতি বছর থার্টিফার্স্ট নাইটে আতশবাজির কারণে অনেক পাখি, বন্যপ্রাণী মারা যায়; প্রবীণ, শিশু, নবজাতক আতঙ্কিত হয়। হার্টের রোগীরা দিশাহারা এবং হাসপাতালে রোগীরা বিপন্ন হয়ে পড়ে। যারা নিছক আনন্দের জন্য টাকা খরচ করে এ নির্মম কাজটি করি এবং করাই তারা যেন নীরব ঘাতক শব্দদূষণকে উৎসাহিত না করি। উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ করা একটি অমানবিক কাজ। শব্দদূষণ একটি নীবর ঘাতক। বর্তমানে মাটি-পানি-বায়ু-শব্দ দূষণ যেন মানুষের জন্য অভিশাপ। শব্দদূষণের ফলে মানুষের বহুমাত্রিক স্বাস্থ্যঝুঁকিসমূহ হলো মাথাব্যথা, অনিদ্রা, কানে কম শোনা এবং আংশিক বা পুরোপুরি বধিরতা, কানের ভেতর ঝিঁঝিঁ শব্দ, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মনোযোগ কমে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে, মানসিক চাপ, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ, ক্ষুধামান্দ্য, গ্যাস্ট্রিক এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্ম হওয়া।

জনস্বাস্থ্য ও সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর শব্দের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো ও শব্দদূষণের বিরুদ্ধে কার্যক্রম গ্রহণে কমিউনিটিকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কাজ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে শব্দদূষণ বিশ্বব্যাপী একটি অন্যতম জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্প্রতি সরকার শব্দদূষণ নিযন্ত্রণের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরির্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালনায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনগণকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি শব্দদূষণ রোধে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

ঢাকাসহ বড় বড় শহরের শব্দদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। গাড়ির হর্ন, অ্যাম্বুলেন্সের মাত্রাতিরিক্ত শব্দ, আতশবাজির শব্দ, গণপরিবহন, মোটরসাইকেলে বিকট শব্দের হর্ন, নির্মাণকাজের ইটপাথর ভাঙার শব্দ, সভাসমাবেশের মাইক, প্রচার কার্যক্রম, সামাজিক অনুষ্ঠানের উচ্চশব্দ, সংগীতানুষ্ঠানের সাউন্ডবক্স নিয়মনীতির তোয়াক্ষা না করেই বাজিয়ে চলেছে। এসব শব্দের ঘনত্ব এতটাই বেশি যে গাড়ির কাচ বন্ধ রেখেও কিছুমাত্র রেহাই পাওয়া যায় না। পথচারী আর গণপরিবহন ব্যবহারকারীর কথা না-ই বা বললাম। শব্দদূষণের অস্তিত্ব আগে রাস্তায় বের হলে টের পেতাম আর এখন বাসায় বসেই টের পাই।

মাটি, পানি কিংবা বায়ুদূষণ উপলব্ধি করতে কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু শব্দদূষণ সরাসরি আঘাত হানে আমাদের কানে, হৃদয়ে আর মগজে। তাই শব্দদূষণকে নীরব ঘাতক বলার আর কোনো সুযোগ নেই।

শব্দদূষণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী ঢাকার জন্য দিনের বেলায় শব্দের আদর্শ মান ৬০ ডেসিবেল। অথচ স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা ৭৬ দশমিক ৮০ ডেসিবেল এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮০ দশমিক ৫৬ ডেসিবেল। শব্দদূষণের কারণে আমাদের শ্রবণশক্তি কমে যাচ্ছে, বধিরতা বাড়ছে, মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে, শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দদূষণের প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়ে গর্ভবতী মায়েদের ওপর। গর্ভবতী মায়ের কানের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে। মা যখন উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন, ঘুম ঠিকমতো না হলে এর প্রভাব গর্ভের সন্তানের ওপর পড়ে। শেষের তিন মাস গর্ভের বাচ্চারা বাইরের শব্দ শুনতে পায়। উচ্চশব্দে তাদেরও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। এতে বাচ্চাদের শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, ওজন কমে যেতে পারে, এমনকি সময়ের আগেই প্রিম্যাচিউর শিশুর জন্ম হতে পারে।

বিধিমালার ৭ নম্বর ধারায় ‘শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম নিষিদ্ধ’-এর বর্ণনায় বলা হয়েছে, অনুমতিপ্রাপ্ত না হলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো এলাকায় শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবে না। দেখা গেছে, এ দেশে যেসব রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক অনুষ্ঠান আবাসিক এলাকায় আয়োজিত হয়, এর জন্য কখনোই কারও অনুমতি নিতে হয় না, এমনকি অনুমতি নেওয়ার যে একটা বিধি বা আইন আছে, তা-ও বেশিরভাগ মানুষ জানে না। যদি কেউ জেনেও থাকে তারা এসবের তোয়াক্কা করে না। গবেষণা থেকে স্পষ্ট, শব্দদূষণের সঙ্গে বধিরতার সম্পর্ক রয়েছে। আকস্মিক তীব্র শব্দে অন্তত কানের ক্ষতির কারণে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। প্রতিদিন একজন মানুষ কতটুকু শব্দের মধ্যে অবস্থান করতে পারবে, এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানদণ্ড দিয়েছে। ১৩০ ডেসিবেল ১ সেকেন্ডের কম, ১২৫ ডেসিবেল ৩ সেকেন্ড ১২০ ডেসিবেল ৯ সেকেন্ড, ১১৫ ডেসিবেল ২৮ সেকেন্ড, ১১০ ডেসিবেল ৩০ সেকেন্ড, ১০৫ ডেসিবেল ৪ মিনিট, ১০০ ডেসিবেল ১৫ মিনিট, ৯৫ ডেসিবেল ৪৭ মিনিট, ৯০ ডেসিবেল ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট, ৮৫ ডেসিবেল ৮ ঘণ্টা।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে কাজ হচ্ছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ধারাবাহিকভাবে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। অবশেষে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ সালের আলোকে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়েছে। ওই বিধিমালায় শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ নির্দেশিত এলাকাভেদে শব্দের মানমাত্রাÑ নীরব এলাকা দিনে ৫০, রাতে ৪০; আবাসিক এলাকা দিনে ৫৫, রাতে ৪৫; মিশ্র এলাকা দিনে ৬০, রাতে ৫০; বাণিজ্যিক এলাকা দিনে ৭০, রাতে ৬০; শিল্প এলাকা দিনে ৭৫, রাতে ৭০ ডেসিমেল। বায়ু, পানি ও মাটিদূষণের মতো শব্দদূষণ সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এ বলা আছে, প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসমূহ নিজ নিজ এলাকার মধ্যে আবাসিক, বাণিজ্যিক মিশ্র, শিল্প বা নীরব এলাকাসমূহকে চিহ্নিত করে স্ট্যান্ডার্ড সংকেত বা সাইনবোর্ড স্থাপন ও সংরক্ষণ করবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে সে কোথায় কী করতে পারবে।

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) সমীক্ষা বলছে, যানবাহনের শব্দদূষণের কারণে ১১.৮ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশে জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে ১৫.৫ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের সাধারণভাবে মোবাইল ফোনে কথা শুনতে অসুবিধা হয়, ১৯.১ শতাংশকে ঘরের অন্য সদস্যদের তুলনায় বেশি ভলিউম দিয়ে টিভি দেখতে হয়, উচ্চৈঃস্বরে কথা না বললে তাদের কথা শুনতে কষ্ট হয়, ৩৩.৯ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ উচ্চৈঃস্বরে কথা না বললে শুনতে পায় না এবং ৮.২ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর মাথা ঘোরা, বমিভাব ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আসুন শব্দদূষণ নিয়ে আমরা প্রত্যেকেই সচেতন হই। নিজে বাঁচি, অন্যকে বাঁচাই।

  • পরিবেশকর্মী
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা