× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নারীর প্রতি সহিংসতা

এখনও কাটেনি আঁধার

খুশি কবির

প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৪৯ পিএম

এখনও কাটেনি আঁধার

বিদায়ি বছর গোটা বিশ্বে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নানাভাবে পাল্টে গেছে। দেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান প্রধান আলোচনার বিষয়। বিদায়ি বছর নারীর জন্য নিশ্চিত ভিন্নরকম ছিল। বছরের মাঝামাঝি রাষ্ট্রকাঠামোয় বড় পরিবর্তন এবং এ পরিবর্তনের আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। বিশেষত আন্দোলনের কঠিন ও ক্রূর সময়েও নারী যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবেই দেশের জন্য গৌরবোজ্জ্বল। কিন্তু বছরের প্রান্তিকে যখন জননিরাপত্তা বড় সংকট হিসেবে দেখা দেয় তখন নারীর নিরাপত্তাও ছিল কম। অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে নারীদের। নিরাপত্তাহীনতায় ‍ভুগেছে বেশিরভাগ নারী। বিগত বছরগুলোর মতো ২০২৪ সালজুড়ে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অনলাইনে যৌন হয়রানিসহ শিশুর প্রতি নানা সহিংস ঘটনা অব্যাহত ছিল। গত বছরগুলোর তুলনায় বিদায়ি বছরে নারী-শিশু নির্যাতন আর ধর্ষণের ঘটনা তুলনামূলক কিছুটা কম হলেও ধর্ষণ শেষে হত্যা আর শিশু খুনের ঘটনা বিগত বছরগুলোর চেয়ে বেশি। এ সময়ে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, সহিংসতার কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৪৮২ শিশু। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪০৩। শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও গেল বছরে বেশি সংঘটিত হয়েছে।

১ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪ সালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৯৪টি। নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬১২ জন। যার মধ্যে কন্যাশিশু ৩৩১ ও নারী ২৮১ জন। এ ছাড়া ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ১৮৫টি। যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ২৩৬টি। পুলিশ সদর দপ্তর, হাসপাতাল, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০২৪ সালের শুরু থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪০৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১০৪ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার। ধর্ষণ শেষে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৪৭ জন। ধর্ষণের শিকার কন্যাশিশুর সংখ্যা ২৫৪। ৩৯ কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ৪২ কন্যাশিশু, প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু রয়েছে ১১। একই সূত্রমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ১ হাজার ৫৭৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৯ জনকে। ২০২২ সালে ১ হাজার ৯৯৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের সময় এবং পরে হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে।

শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই যুগ যুগ ধরে নারীর অবদান অনেক। ঘরে, কৃষিতে, অফিস-আদালতে, কলকারখানা— সব জায়গায় নারীর অবদান রয়েছে। উৎপাদনমুখী যেকোনো কাজে নারী এবং পুরুষ যে-ই অংশগ্রহণ করুক সবারই অবদান রয়েছে। কিন্তু সাধারণত সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়নে নারীর অবদান সামনে নিয়ে আসা হয় না। নারীর অবদান উপেক্ষা করা হয়। বছরের পর বছর ধরে এটাই আমরা দেখছি। বিশেষ করে একজন নারী যখন বাইরের কাজ করে অর্থ উপার্জন করছেন না বা তার ঘরের কাজকে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। নারীর ঘরের কাজের যে একটি অর্থনৈতিক মূল্যায়ন রয়েছে সেটা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা এতদিন গ্রহণ করেননি। তবে এখন অনেক অর্থনীতিবিদ বিশ্ব জুড়েই নারীর এ ঘরের কাজকে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়নের কথা বলছেন। তারা দেশের জিডিপি হিসাব করার ক্ষেত্রেও এটাকে হিসাব করছেন। নারীর এই ঘরের কাজকে সেবামূলক খাতের মধ্যে ধরা হচ্ছে। অথচ এ অপ্রাতিষ্ঠানিক সেবাকে যদি আমরা স্বীকৃতি দিতে না পারি তাহলে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

বিশেষত নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নারীর সব ধরনের অভিগম্যতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে। নারী যখন সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার পাবে তখন সঙ্গতই তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে। দেশের অধিকাংশ নারী এখনও স্বামীর ওপর নির্ভরশীল। এ নির্ভরশীলতা তারা কাটাতে পারছে না সামাজিক দৃষ্টিকোণ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবের কারণে। সমাজের দৃষ্টিকোণে বড় রদবদল আনা জরুরি। কাজটি অবশ্য দ্রুত সম্ভব না। পটপরিবর্তনের পর আমরা যে ধরনের সংস্কার প্রত্যাশা করছি তা নিশ্চিত করা গেলে নারীর অধিকারও নিশ্চিত হবে। বিশেষত নারীর জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। দেশে ভালো কিছু আইন আছে। কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই অনেক ক্ষেত্রেই। যখনই আইনের প্রয়োগ বাঞ্ছনীয় হয়ে ওঠে তখন আইনি দীর্ঘসূত্রতা আরেক সংকট তৈরি করে। এসব সমস্যা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। যদি তা না করা যায়, তাহলে নারী নির্যাতন আরও বাড়বে। কারণ অপরাধীরাও আইনের দীর্ঘসূত্রতা দেখে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কাঠামোর স্থবিরতাই তাদের উৎসাহ জুগিয়ে থাকে।

এ কথা বলতে হবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষায় নারী সব সময় ভালো ফল পাচ্ছে। অন্যদিকে ক্রীড়াক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসতে পারছে। নারী তার সামর্থ্য অনুযায়ী ক্রীড়াক্ষেত্রে যে সাফল্য প্রদর্শন করেছে তা আমাদের অংশগ্রহণের সান্ত্বনা থেকে বের করে এনেছে। অনেক বিষয়ে নারী অগ্রগতি অবশ্যই হয়েছে। ১৯৭২ সালে নারীদের রাস্তাঘাটে অভিগম্যতা কম ছিল। কিন্তু এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য কিন্তু ঈর্ষণীয়। দেশের নারীদের এই যে উন্নয়ন, তা কিন্তু বিশ্বস্বীকৃত, প্রশংসিত। নারীর অগ্রগতির হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, এমনটি বলা যাবে না। তবে নারী-পুরুষে যে বৈষম্যের হার, তা দ্রুতগতিতে কমানো গেছে এবং দেশের এ পরিবর্তনটা বেশ দৃশ্যমান এবং বিশ্বেও সমানভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। তবে এও সত্য, বাল্যবিবাহের হার বেড়ে গেছে। বিশেষ করে দেশে এ সমস্যাটা অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে, বিভিন্ন দেশের তুলনায়। এর পেছনে মূল কারণ মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির ফলে সামাজিক শ্রেণিবিভেদে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে। আর এ সমস্যা আমাদের দেশে অনেক বেশি। আপাতত অর্থনীতিতে বিষয়টি দৃশ্যমান নয় কারণ নারীর অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমকে এখনও গণনা করা হয় না। আবার দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় খাত তৈরি পোশাকশিল্পের বড় অংশীজন নারী। নারীর অভিগম্যতা বাড়ার পরও নারীর অবমাননা কমানো যাচ্ছে না। নারীদের মজুরি কম দেওয়া হচ্ছে। যদিও আইএলও কনভেনশনে আছে সমঅধিকারের কথা, সমমজুরির কথা। শুধু আইএলও কনভেনশন কেন, বাংলাদেশের আইনেও কিন্তু মজুরি সমান এবং ছয় মাসের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটির কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছয় মাসের ছুটি তো দেয়ই না, উল্টো ছাঁটাই করে। বিবাহিত হলে কোনো কর্মীকে নিতে চায় না। অবশ্য এ সমস্যাটা শুধু আমাদের একার নয়, অন্য অনেক দেশেই আছে। 

বিচারব্যবস্থায় নারীকে অশোভন এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিশেষত ধর্ষণ মামলার বাদীকে কিংবা যৌন নির্যাতনের মামলার যেকোনো নারীকে; সেটারও পরিবর্তন আনা জরুরি। সমাজের লোকেরা কোর্টের বাইরে যেভাবে সালিশ করে দেয় সেটাও কিন্তু নারীদের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখে না। এ প্রথাও কিন্তু এখনও চলমান আমাদের দেশে। দেশের অনেক অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও মূল দুটি জায়গায় ঠিকভাবে উন্নয়নটা সাধন করতে পারিনি। একটি হলো নারীর নিরাপত্তা, আরেকটি নারীর মর্যাদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা এখনও অনেকটা পিছিয়ে আছি।

নারীর জন্য আইন অনুযায়ী আলাদা ট্রাইব্যুনাল আছে। তার পরও কিছু মান্ধাতা আমলের আইন এখনও আছে যার পরিবর্তন সময়ের দাবি। একই ধরনের আইন কিন্তু পাশের বিভিন্ন দেশে পরিবর্তন করে সময়োপযোগী করা হয়েছে। ফলে অপরাধ ঘটছে, অপরাধী ধরাও পড়ছে; কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে অপরাধ কমছেই না। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতার অপরাধ।

  • মানবাধিকারকর্মী ও সমন্বয়ক, নিজেরা করি
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা