সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:২১ এএম
‘নতুন উচ্চতায় রেমিট্যান্স’ শিরোনামে ২ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের বার্তা নিঃসন্দেহে সুবার্তা। আমরা জানি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, বিদায়ি বছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা নতুন রেকর্ড গড়েছে। এর আগে এত বড় রেমিট্যান্স কোনো বছর আসেনি। দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় আহরণের বার্তা এ তাগিদই দিয়েছেÑ প্রবাসীদের বৈধ হতে দেশে তাদের আয় পাঠানোর পথ মসৃণ রাখতেই হবে। আমরা এও জানি, সরকার এ ক্ষেত্রে বাড়তি প্রণোদনা দিচ্ছে বটে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত পর্যায়ে কিছু প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতাও যে রয়েছে তা-ও সত্
আমাদের বিশ্বাস,
বিদ্যমান প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা সর্বাংশে দূর করতে পারলে এর ইতিবাচক প্রভাব আরও বেশি
দৃশ্যমান হবে। এও আমাদের অজানা নয়, হুন্ডি চক্রের থাবায় বৈধ পথে প্রবাসী আয় আহরণে ফিরে
ফিরে সংকট সৃষ্টি হয়। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বরাবরই বলে আসছেন, হুন্ডি চক্র ও অর্থ পাচারকারীদের
মূলোৎপাটন করতে পারলে এ আয়প্রবাহ অন্তত আরও দেড় গুণ বাড়বে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর
প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১১ মাসে প্রবাসে গেছেন ৯ লাখ কর্মী। ২০২৩ সাল
শেষে বিদেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জনশক্তি ছিল প্রায় ১ কোটি ৭ লাখ। এর নিরিখে দেখা
গেছে, প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। এ আয়ের জোরালো প্রবাহের ফলে কেন্দ্রীয়
ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে (২৯ ডিসেম্বর,
২০২৪ পর্যন্ত) ২ হাজার ৬১০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসাব
পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী এর পরিমাণ ২ হাজার ১৩৪ কোটি ডলার। সুখকর বার্তা হলো, দীর্ঘদিন
পর বিপিএম৬ হিসাব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
ইতিপূর্বে এই
সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছিলাম, প্রবাসী আয় বাড়াতে বহুমুখী উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের
জানা আছে, কিছুদিন আগেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নগামী হচ্ছিল অতীতের ধারাবাহিকতায়।
এ কারণেই সংকট বাড়ছিল ডলারেও। কিন্তু এ দুই নেতিবাচকতাই অপসারিত হয়েছে, বিদ্যমান বাস্তবতা
এ সাক্ষ্যই দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রবাসী আয় আরও কীভাবে বাড়ানো যায় এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের
কিছু সুপারিশ উঠে এসেছিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে কয়েকদিন আগে। আর্থিক খাত
বিশ্লেষক ও ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের অভিমত, বর্তমানে প্রবাসীরা যে পরিমাণ আয় বৈধ পথে
দেশে পাঠাচ্ছেন তা বাড়াতে পারলে প্রবাসী আয়প্রবাহে জোয়ার সৃষ্টি হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজার
ও রিজার্ভ চিত্র আরও উজ্জ্বল হবে।
ইতঃপূর্বে এও
জানা গিয়েছিল, হুন্ডি ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রবাসী আয়ের বড় অংশই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে,
যার বার্ষিক মোট পরিমাণ প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। সেই প্রেক্ষাপটে স্বস্তির বার্তা হলো,
সরকারের দূরদর্শী পরিকল্পনায় অবৈধভাবে প্রবাসী আয় আসার পথ সংকুচিত হয়েছে। প্রবাসী আয়
হুন্ডি চক্রের গ্রাসমুক্ত করতেই হবে, এ তাগিদও আমরা সম্পাদকীয় স্তম্ভেই দিয়েছিলাম।
প্রবাসী কর্মীদের ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের
যে অবদান সে প্রেক্ষাপটে তাদের যথাযথ অবস্থান নির্ণীত হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। তারা
যাতে বৈধ পথে তাদের আয় দেশে পাঠাতে পারেন এবং দেশে যাতে তাদের পরিবার-পরিজন প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে
তা সহজে পেতে পারেন সে পথ আরও সুগম করার বিকল্প নেই। একসময় আমাদের শ্রমবাজার মূলত মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক
থাকলেও এখন তা ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, মালয়েশিয়া এবং আরও অনেক দেশেই
বর্তমানে আমাদের শ্রমবাজার বিস্তৃত। সংবাদমাধ্যমের তরফে এও উঠে এসেছে, বিদেশে যখন আমাদের
শ্রমবাজার ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছিল তখন হুন্ডিচক্রসহ নানা অসাধু মহলের অপতৎপরতাও বাড়ছিল
সমান্তরালে।
আমরা মনে করি,
ব্যাংক খাতসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা যদি সুচারু করা যায়, তাহলে এর আরও সুফল দৃশ্যমান
হতে বাধ্য। যেসব উপসর্গ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রতিবন্ধক হিসেবে বিদ্যমান সেগুলোর
দ্রুত নিরসন ঘটিয়ে সেবার পথ সুগম করতে হবে। ২ জানুয়ারি সহযোগী একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে
বলা হয়েছে, আশঙ্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ব্যাংক খাত। আমরা জানি, ব্যাংক খাত সংস্কারে
একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযোগ আছে, ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনার
কারণেও বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর
প্রতিবেদনেই নিকট অতীতে আরও জানা গিয়েছিল, বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসার ক্ষেত্রে ‘বিকাশ’
অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। এ মাধ্যমটির সেবার মান যেভাবে সুবিন্যস্ত করছে, সেভাবে
দেশের ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম প্রবাসীদের জন্য আরও অনুপ্রেরণামূলক করার পরিকল্পনা ও
বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রবাসীদের বৈধ পথে তাদের আয়
দেশে পাঠাতে উৎসাহিত করার ব্যবস্থাও সরকারি পর্যায়েই নিতে হবে। ছুটির দিনেও যেন প্রবাসীরা
তাদের আয় দেশে পাঠাতে পারেন সে ব্যবস্থা রাখার পরামর্শও অর্থনীতিবিদদের তরফে উঠে এসেছে।
তারা প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আনার প্রভাব
বৃদ্ধির পথও বাতলে দিয়েছেন। আমরা মনে করি, তাদের সুপারিশগুলো আমলে নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
কোনো প্রবাসী
তার আয় দেশে পাঠানোর পর তা উত্তোলন করতে গিয়ে গ্রহীতা যদি উন্নতমানের সেবা পান, তাহলে
বৈধ পথে প্রবাসী আয় প্রেরণকারীর সংখ্যা নিশ্চয়ই বাড়তে থাকবে। আমাদের দূতাবাসগুলোকে
নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধানেও মনোযোগ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে জোর দিতে হবে দক্ষ কর্মী
পাঠানোর ব্যাপারেও। কারণ বিশ্বের শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ও চাহিদা ক্রমেই
বাড়ছে। দূতাবাসগুলোকে নজর রাখতে হবে প্রবাসীরা যেন কোনো কারণে হেনস্থার শিকার না হন।
একই সঙ্গে কর্মসন্ধানীদের বিদেশে যেতে বৈধ পথ অবলম্বন করতে হবে। অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি
দেওয়ার বহুমাত্রিক ঝুঁকি কতটা প্রকট, এর নজির তো কম নেই। প্রবাসী কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য
অংশ মূলত নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। তাদের অনেকেরই সচেতনতার অভাবের
পাশাপাশি দেশে বৈধভাবে আয় পাঠানোর ব্যাপারেও জানার অনেক ঘাটতি রয়েছে। তা ছাড়া যে মাধ্যমে
তারা বেশি মুনাফা পাবেন সেদিকেই ধাবিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার
কোনো ত্রুটির কারণে হুন্ডিচক্র যাতে সুযোগ নিতে না পারে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর আরও গভীর করতে হবে, যাতে ব্যাংক বা বৈধ মানি এক্সচেঞ্জের
মাধ্যমে তুলনামূলক কম খরচে ও যথাযথ মুদ্রার বিনিময় প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রবাসীরা তাদের
আয় পাঠাতে পারেন।