× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অর্থনীতি

ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ লাঘব করুন

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:১৬ এএম

নিরঞ্জন রায়

নিরঞ্জন রায়

আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের নিয়ে আছে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা। দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কতজন কতটা ভালো বা খারাপ, সে আলোচনা দূরে সরিয়ে রেখেও খুব সহজেই বলা যেতে পারে যে, দেশের ব্যবসায়ীদের দিকে অভিযোগের তিরটি বেশি লম্বা। ব্যবসায়ীরা মুনাফাখোর, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম হোতা, বাজার সিন্ডিকেটের সদস্য এবং ঋণখেলাপির মতো বিষয়গুলো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে খুবই নিয়মিত অভিযোগ। এসব অভিযোগের সত্যতা যে একেবারে নেই তেমন নয়। কিছু ব্যবসায়ী নিশ্চয়ই এসব অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকেন এবং ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এ কারণেই ওঠে। তবে অধিকাংশ ব্যবসায়ী যে এ ধরনের অন্যায় কাজে জড়িত নন, তাতে কারও দ্বিমত পোষণের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।

এসব অভিযোগ মেনে নিয়েও বলা যায় ব্যবসায়ীদের সমস্যা এবং ভোগান্তিও একেবারে কম নয়। আমাদের দেশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠা করা এবং সেটি সফলভাবে চালিয়ে নেওয়া প্রায় অসাধ্য সাধন করার শামিল। ব্যবসা পরিচালনার জন্য সনদ সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ের লাভ ঘরে তোলার মতো কাজগুলো সম্পন্ন করতে হয় নানান প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে। ব্যবসায়ের মূলধন জোগাড় করতে গেলে সমস্যার শেষ নেই। পণ্য সংগ্রহ এবং মূল্যের জন্য সরবরাহকারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হয়। নিজেরা বাকিতে পণ্য সংগ্রহ করতে না পারলেও বাকিতে ঠিকই গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে হয়। আবার এ বাকির বিরাট একটি অংশ আদায়ও হয় না। অবস্থা এমন যে, কোনো ব্যবসা পরিচালনা করতে গেলেই ব্যবসায়ীদের পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন এবং বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে।

ব্যাংকে কোনোরকম সেবা নিতে গেলেই নানান বিড়ম্বনা বা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। হিসাব খুলতে, অর্থ উত্তোলন করতে, অর্থ স্থানান্তর করতে, ঋণ নিতে হেন কোনো কাজ নেই যে সেখানে সমস্যা বা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না। হ্যাঁ কথা সত্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হয় না, কারণ ব্যাংক তাদের পছন্দমতো যতসব কাগজপত্র দিতে বা স্বাক্ষর করতে বলবে, তার সবকিছু যদি না বুঝে স্বাক্ষর করে দেওয়া হয়, তাহলে আর কোনো সমস্যা হয় না। বাস্তবে অধিকাংশ গ্রাহক হয় না বুঝে অথবা নিরুপায় হয়ে ব্যাংকের চাহিদামতো কাগজপত্র স্বাক্ষর করে দিয়ে থাকেন এবং এজন্য সমস্যার বিষয়টি সেভাবে আলোচনা হয় না। যখনই কোনো গ্রাহক প্রশ্ন তুলবেন কেন এ ডকুমেন্ট প্রয়োজন, তখনই তার সেবা আটকে যাবে। অর্থাৎ একজন সচেতন গ্রাহক হিসেবে যখনই তার অধিকার প্রয়োগ করতে যাবেন, তখনই সেই গ্রাহক যে ব্যাংকে কাজ করতে গিয়ে শুধু সমস্যায় পড়বেন, তেমন নয়, কোনোরকম সেবাই হয়তো তিনি পাবেন না।

আমার এ মন্তব্য অনেকেই অতিরঞ্জিত ভাবতে পারেন। তাদের জ্ঞাতার্থে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি। ধরুন, একজন গ্রাহক ব্যাংকের ইস্যু করা দশ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত বা ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডের বিপরীতে ঋণ গ্রহণ করতে চান। উল্লেখ্য, ব্যাংকের পরিভাষায় স্থায়ী আমানত বা ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডকে ক্যাশ কোল্যাটারাল বলা হয়। প্রথমেই সেই গ্রাহককে এ ক্যাশ কোল্যাটারালে স্বাক্ষর দিয়ে ডিসচার্জ করে দিতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে ব্যাংক যখনই মনে করবে তখনই সেই গ্রাহকের জমা দেওয়া ক্যাশ কোল্যাটারাল ভাঙিয়ে প্রদত্ত ঋণ পরিশোধ করে ফেলতে পারবে। আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য এবং তা হচ্ছে, ব্যাংক কিন্তু দশ লাখ টাকার ক্যাশ কোল্যাটারালের বিপরীতে দশ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করবে না। সর্বাধিক আট লাখ টাকার ঋণ প্রদান করতে পারে এবং দুই লাখ টাকার মার্জিন হাতে রাখবে কখনও প্রয়োজনে বকেয়া সুদসহ ঋণের টাকা আদায় করতে যেন কোনো সমস্যা না হয়।

আলোচ্য ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা সরিয়ে রেখে একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে যে, ক্যাশ কোল্যাটারালের বিপরীতে ব্যাংকপ্রদত্ত ঋণের অর্থ ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই একজন গ্রাহক যখন ক্যাশ কোল্যাটারাল সম্পূর্ণ ডিসচার্জ করে ব্যাংকে দিয়ে দেয়, তখন সেই ঋণ গ্রহণের জন্য আর কোনো কাগজপত্র প্রদানের প্রয়োজন থাকতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ব্যাংক ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে একগুচ্ছ কাগজপত্র স্বাক্ষর করিয়ে নেবে, যার মধ্যে ঋণগ্রহীতার ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা পত্র বা পারসোনাল গ্যারান্টি এবং একটি খালি চেকবইয়ের পাতাও থাকতে হবে। সেই ঋণগ্রহীতা যদি বলে যে আমি তো ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তাস্বরূপ পুরো ক্যাশ কোল্যাটারাল ডিসচার্জ করে জমা দিয়েছি, তাহলে পারসোনাল গ্যারান্টি এবং চেকবইয়ের খালি পাতা জমা দিতে হবে কেন? তাৎক্ষণিক ব্যাংক সেই গ্রাহককে জানিয়ে দেবে যে, এগুলো দিলে তার ঋণ হবে, নচেৎ নাই। তারা একবারও বোঝার চেষ্টা করবে না যে আসলে এ অতিরিক্ত ডকুমেন্টের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না।

এখন অনেক ব্যাংকার হয়তো আমার মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলার চেষ্টা করবেন যে, ব্যাংক এসব ডকুমেন্ট কখনই প্রয়োগ করে না। শুধু অডিট আপত্তি থেকে বাঁচার জন্য নিয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ যে ডকুমেন্ট ব্যাংক কখনই প্রয়োগ করবে না বলে মনে করে, সে রকম ডকুমেন্ট নিতে হবে কেন? আর এ রকম ডকুমেন্ট না নেওয়ার কারণে অডিট আপত্তিই বা উঠবে কেন? আসলে এসব হালকা কথা বলা হয় শুধু ডকুমেন্টগুলো সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে যখন ব্যাংকের প্রয়োজন হয় তখন এ ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে পদক্ষেপ নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আর মাঝখান থেকে বিপদে পড়ে যান বেচারা গ্রাহক।

প্রয়োজন ছাড়া প্রদত্ত অতিরিক্ত ডকুমেন্টের অপপ্রয়োগ যে কি ভয়ংকর হতে পারে তা একটি কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। ধরা যাক একজন গ্রাহক ব্যাংকে দশ লাখ টাকার ক্যাশ কোল্যাটারাল জমা দিয়ে তার বিপরীতে আট লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এ ঋণের জন্য অন্যান্য ডকুমেন্টের সঙ্গে ঋণগ্রহীতা তার পারসোনাল গ্যারান্টি এবং চেকবইয়ের একটি পাতা অলিখিতভাবে শুধু স্বাক্ষর করে জমা দিয়েছেন। এখন দেখা গেল সেই ঋণ হিসাব থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে পঞ্চাশ লাখ টাকার অতিরিক্ত ঋণ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক প্রথমেই জালিয়াতি স্বীকার করে তা প্রমাণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। প্রথমেই এটি গ্রাহকের ঋণ হিসাব দেখাবে, ফলে সেই গ্রাহককে এ ঋণ পরিশোধে বাধ্য করা হবে। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাংক গ্রাহককে নির্দিষ্ট একটা সময় বেঁধে সমুদয় অর্থ ফেরত দিতে বলবে। না দিলেই গ্রাহকের পারসোনাল গ্যারান্টি প্রয়োগ করে তার অন্যান্য সম্পত্তি নিয়ে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করবেন। নতুবা গ্রাহকের জমা দেওয়া ব্ল্যাঙ্ক চেক ব্যবহার করে তাকে জেলে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। সেই গ্রাহকের যদি সামর্থ্য থাকে এবং তিনি যদি ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন, তাহলে শেষ বিচারে কী হবে তা হলফ করে বলা মুশকিল। হয়তো বিচারের রায় গ্রাহকের পক্ষে যাবে। কিন্তু ততদিনে গ্রাহক যে কী ভয়ংকর বিপদের মধ্যে থাকবেন, তা ভাবতেও গা শিউরে উঠে। অথচ এ অবস্থার সৃষ্টি হবে না, যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাগজপত্র, যেমন পারসোনাল গ্যারান্টি, ব্ল্যাঙ্ক চেক ব্যাংকে জমা দেওয়া না হয়।

এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে যেখানে ব্যাংকে কাগজপত্র জমা দেওয়া নিয়ে গ্রাহকের ভোগান্তির শেষ নেই। আবার এ কথাও ঠিক যে এ কাগজপত্র জমা দেওয়ার বিষয় নিয়েই ব্যাংকারদের কাজের সবচেয়ে অডিট আপত্তি দেখা দেয়। এসব অডিট আপত্তি ঠিক করতে ব্যাংকারদের গলদঘর্ম হতে হয়। এমনকি অডিট আপত্তির পরিমাণ বেশি হলে এবং সেগুলো সঠিকভাবে নিষ্পত্তি না হলে অনেকের পদোন্নতি এবং বেতন বৃদ্ধি স্থগিত হয়ে যায়। ফলে যেসব ব্যাংকার শাখায় এবং গ্রাহক পর্যায়ে কাজ করেন তারা থাকেন উভয়সংকটে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং প্রধান কার্যালয়ের বেঁধে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী সব কাগজপত্র নিতে গেলে গ্রাহক অসন্তুষ্ট হয়। আবার গ্রাহককে সন্তুষ্ট করতে গেলে কাগজপত্রে ঘাটতি থাকে যার কারণে অডিট আপত্তি দেখা দেবে। বাস্তবে এ অবস্থা মোটেই হওয়ার কথা ছিল না যদি ইন্ডাস্ট্রি প্র্যাকটিস নিশ্চিত করে একটি মানসম্পন্ন ডকুমেন্টেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হতো। কিন্তু আমাদের ব্যাংকিং খাতে তেমনটা হয়ে ওঠেনি।

একটি দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিতে হলে দেশের ব্যবসায়ীদের স্বচ্ছন্দে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায়ীরা তখনই স্বচ্ছন্দে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন, যখন তারা ব্যাংকে গিয়ে নির্বিঘ্নে লেনদেন করতে সক্ষম হবেন। একজন ব্যবসায়ীকে প্রতিনিয়ত ব্যাংকে যেতে হয় নানানরকম লেনদেন করার জন্য। সেই লেনদেনে যখন বিঘ্ন ঘটে, তখন ব্যবসার গতিপথ থমকে যায়। এ কারণেই ব্যাংকের সেবার মান এমন সহজ করতে হবে, যাতে ব্যবসায়ীরা কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই এবং একটুও বিড়ম্বনার সম্মুখীন না হয়ে তাদের আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন। মোট কথা দেশের অর্থনীতির বৃহত্তম স্বার্থেই ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ লাঘব করা প্রয়োজন, যার শুরুটা করতে হবে ব্যাংক থেকে।

  • সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার , টরন্টো, কানাডা
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা