অনিয়ম
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:১৩ এএম
মহিউদ্দিন খান মোহন
‘বাবা কেন চাকর’, ‘স্বামী কেন আসামি’ নামে বাংলাদেশে সিনেমা নির্মিত হলেও ‘চাচা কেন বাবা’ নামে কোনো সিনেমা আজতক নির্মিত হয়নি। এবার বোধকরি এ নামেও সিনেমা বানানোর হিড়িক পড়ে যেতে পারে। কেননা, কোথাও কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে সিনেমা-নাটক তৈরির প্রবণতা আমাদের দেশের অতিপ্রচীন ঐতিহ্য। আগের দিনে এ ধরনের ঘটনায় দুই পাতার কবিতা বেরোত। পয়ার কিংবা ত্রিপদী ছন্দে লেখা সে কবিতা নামের কাহিনী হাটবাজারে বিক্রি হতো দেদার। লোকমুখে শোনা কাহিনী ছাপার অক্ষরে পাঠ করে মানুষ কৌতূহল মেটাতে চাইত। এখন আর সেই কবিতার বাজার নেই। সম্ভবত গদ্য কবিতার প্রবল দাপটে টিকতে না পেরে সেসব গীতিকবি বিদায় নিয়েছেন। তার পরিবর্তে এসেছেন নাটক-সিনেমার নির্মাতারা। পিলে চমকানো বা চক্ষু চড়কগাছ হয় এমন ঘটনার সঙ্গে কল্পনার মালমসলা মিশিয়ে তারা মানুষের মনঃখাদ্যের উপযোগী জিনিস তৈরি করে পরিবেশন করেন। মানুষও তা হাপুসহুপুস গেলে।
পাঠক বোধকরি ধন্দে
পড়ে গেছেন, কেন শুরুতেই বললাম, ‘চাচা কেন বাবা’ নামে সিনেমা নির্মিত হবে। না, বিনা
কারণে ও কথা বলিনি। যারা নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ করেন, তারা বিলক্ষণ এর কারণটি ধরতে পেরেছেন।
২৭ ডিসেম্বর জাতীয় দৈনিকগুলোয় প্রকাশিত একটি চমকপ্রদ সংবাদই আমার এমনতর ভাবনার মূল
কারণ। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা চাচাকে বাবা বানিয়ে উচ্চশিক্ষা ও সরকারি
গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি নেওয়া এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা
করেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম মো. কামাল হোসেন। তিনি নওগাঁর আত্রাই উপজেলা নির্বাহী
অফিসার। খবরে জানা যায়, বিসিএস (প্রশাসন) ৩৫ ব্যাচের এ কর্মকর্তার জন্মদাতা পিতার নাম
আবুল কাশেম, মা মোছাম্মত হাবিয়া খাতুন। কামাল হোসেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার সিরাজনগর
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শেণি পর্যন্ত এবং ফিলিপনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম
শ্রেণিতে পড়ার সময় পর্যন্ত বাবার নাম আবুল কাশেম ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু একই স্কুলে
নবম শ্রেণিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করার সময় বাবার নাম হিসেবে তার আপন চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা
আহসান হাবীব ও মা হিসেবে লেখেন চাচি মোছাম্মৎ সানোয়ারা খাতুনের নাম। খবরে আরও উল্লেখ
করা হয়েছে, প্রতারণার মাধ্যমে কামাল হোসেন তার জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রেও বাবা-মা
হিসেবে চাচা-চাচির নাম উল্লেখ করেছেন। খবরে বলা হয়েছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন
ও সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাওয়ার লোভে তিনি বাবা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা চাচার নাম
ব্যবহার করেছেন। দুদকের এজাহারে বলা হয়েছে, তদন্তের প্রয়োজনে কামাল হোসেনের ডিএনএ টেস্ট
করানো হবে। অন্যদিকে অভিযুক্ত কামাল হোসেন একটি দৈনিককে বলেছেন, তার কোনো প্রতিপক্ষ
গ্রুপ মিথ্যা অভিযোগ দুদকে জমা দিয়েছে। তিনি নাকি মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র জমা
দিয়েছেন। তার কোনো জাল নথিপত্র নেই বলে দাবি করেছেন।
চাচাকে অভিহিত
করা হয় পিতৃব্য হিসেবে। তবে চাচা পিতৃতুল্য হলেও পিতা নন। পিতার অনুপস্থিতিতে চাচা
অনেক সময় ভাতিজা-ভাতিজিদের সন্তানস্নেহে লালনপালনও করে থাকেন। বিশেষ করে পিতৃহীন সন্তানরা
চাচা-মামাদের কাছেই লালিতপালিত হয়ে থাকে। তবে লালনপালন যিনিই করুন, পিতৃহীন সে সন্তান
নিজের পরিচয় লিপিবদ্ধ করার সময় পিতা হিসেবে জন্মদাতার নামই উল্লেখ করে থাকে। অবশ্য
সম্পত্তি আত্মসাৎ কিংবা ভিন্ন কোনো অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে কেউ কেউ প্রতারণার আশ্রয়
নিয়ে পিতা-মাতার নাম বদলে ফেলতে পারে। আলোচ্য ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। কামাল হোসেন উচ্চশিক্ষা
ও পরবর্তী সময়ে সরকারি চাকরিতে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ হিসেবে বিশেষ সুবিধা পেতেই যে
এ অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একেই বলা হয় গোড়াতেই গলদ। যে
ব্যক্তি তার শিক্ষাজীবনের গোড়াতেই পিতার নাম বদলের মতো ন্যক্কারজনক কাজ করতে পারে,
সরকারি চাকরিতে দায়িত্ব পালনকালে সে কত গর্হিত অন্যায় কাজ করেছে বা চাকরিতে বহাল থাকলে
ভবিষ্যতে করবে, তা ভাবলে শঙ্কিত হতে হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা
আমাদের গর্বের সম্পদ, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। জীবন বাজি রেখে তারা এ দেশ স্বাধীন করেছেন।
তাদের অবস্থান অনেক ওপরে। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় এমনভাবে অপব্যবহার
করা হয়েছে যে, এখন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি শোনামাত্রই প্রশ্ন শুনতে হয় ‘আসল না ভুয়া?’
এ যে কত লজ্জার বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না। বস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার
বিধান চালু হওয়ার পর একশ্রেণির অসৎ মানুষ এর অপব্যবহারে লিপ্ত হয়, যা দেখে বর্তমানে
উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামাল হোসেন ছাত্রাবস্থায়ই এর অনৈতিক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়ে
থাকবেন। চাচাকে বাবা বলে চালিয়ে দেওয়া কামাল হোসেনের বিষয়টি এখন দুদকের তদন্তাধীন।
আশা করা যায় সুষ্ঠু তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধা
বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় পুঁজি করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা এতটাই প্রকট আকার ধারণ
করেছিল যে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রীও ছিলেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। সবারই
স্মরণ থাকার কথা সাবেক পূর্ত ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা
বলে পরিচয় দিতেন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার সনদও ছিল। অথচ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে,
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন আট বছর বয়সি বালক। তেমনিভাবে অনুসন্ধানে
বেশ কয়েকজন সচিব ও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ জাল বলে ধরা পড়ে। এ
প্রতারণা বা মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের খবর
পাওয়া যায়নি। কৈফিয়ত দিতে হয়নি সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকেও।
পৃথিবীর অনেক দেশই সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। সেসব দেশে ফ্রিডম ফাইটার বা মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। রয়েছেন তাদের বংশধররা। কিন্তু নিজের বা পূর্বসূরি কারও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় ব্যবহার-অপব্যবহার করে অনৈতিক স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত হন না; যেটা আমাদের দেশে প্রকটভাবে দৃশ্যমান। আসলে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অনৈতিকতা আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে, স্বার্থ হাসিলের জন্য যেকোনো গর্হিত অপরাধ করতেও তারা দ্বিধান্বিত হয় না। ইউএনও কামাল হোসেন শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই পিতৃপরিচয় নিয়ে যে প্রতারণা করেছেন, সেজন্য তার পরবর্তী বাসস্থান হওয়া উচিত শ্রীঘরে। এমন অনাচার-দূরাচার মেনে নেওয়া যায় না। দেখা যাক, কর্তপক্ষ কী ব্যবস্থা নেন।