সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:০৭ এএম
আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:১৩ এএম
২০২৪ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তো বটেই, বিশ্বকাঁপানো অভ্যুত্থানেরও বছর। অনেকের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে নতুন স্বপ্নযাত্রার সড়কে তুলে দিয়েছে। কোটা বৈষম্যের আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন অনেকেই ভাবতে পারেননি এর চূড়ান্ত রূপে গণঅভ্যুত্থানে টানা তিন মেয়াদেরও বেশি সময়ের স্বেচ্ছাচারী একটি রাজনৈতিক সরকারের পতন ঘটবে। ইতিহাস কথা কয়। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নির্মিত হয় অনেক উপাখ্যান যা দেশ-জাতি তো বটেই, বিশ্বেও হয়ে থাকে স্মরণযোগ্য। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং একপর্যায়ে এর বাঁক পরিবর্তনে ছাত্র-জনতার এক কাতারভুক্ত হয়ে রাষ্ট্র বিনির্মাণের সংকল্প যে অধ্যায়ের সূচনা করে এ থেকেই শুরু নতুন স্বপ্নযাত্রা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বৈষম্য-নিপীড়ন, গণতন্ত্রহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল যে, দেশজুড়ে এর প্রতিবাদে জাগরণ ঘটে এবং পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যয় ধারণ করে জাতির যে নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে, নতুন বছরে দিনে আমরা সর্বাগ্রে এর সাফল্য কামনা করি।
নতুন বছরে আমাদের
যাত্রা হোক সেই সংকল্পপুষ্ট যা আনন্দ আর অনন্ত জাগরণের। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের
বিভিন্ন স্তরে সংস্কারের লক্ষ্যে জনদাবির প্রেক্ষাপটে ইতোমধ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশন
গঠন করেছে এবং কমিশনগুলো জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
অনাচার-দুরাচারসহ বহুবিধ দুষ্কর্মের বিরূপ প্রভাবে জনগণের ওপর যখন বৈরী ছায়া ক্রমেই
গাঢ় হচ্ছিল তখনই ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলন-সংগ্রাম নতুন গন্তব্যের পথ খুলে দেয়।
‘গণঅভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা’ শিরোনামে ৩১ ডিসেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ
যথার্থই বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৯০ সালের পর
আরও এক অনন্য বছর হয়ে দেখা দিয়েছে ২০২৪ সাল।’ আমরা মনে করি, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সৃষ্ট
৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট যে পথের দিশা দিয়েছে সে পথ ধরে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের গন্তব্যে
পৌঁছাতেই হবে।
বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থার পতনের মধ্য দিয়ে এ বার্তাও মিলেছে
যে, অনৈতিক উত্থানের পতন এভাবেই ঘটে। আমরা সেসব দুঃসহ স্মৃতি ধারণ করে নতুন প্রত্যয়ে
নতুন বছরে পদার্পণ করেছি। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে খ্রিস্টীয় নববর্ষ ২০২৫ সালকে
আমরা স্বাগত জানাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করে। তিনি বলেছেন, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু
বিরহদহন লাগে;/তবুও শান্তি, তবুও অনন্ত জাগে’। রবীন্দ্রনাথের এ গীতিকাব্যর অন্তর্নিহিত
মর্ম যেন সীমার মাঝে অসীমের মতো। মানবসভ্যতার ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা
ছিল, আছে, থাকবেও। এর মধ্য দিয়েই সময়ের মতো উজানমুখী থাকবে জনজীবন। অভিঘাতের সব ক্ষত
সারিয়ে প্রত্যাশার বীজ চারা গজিয়ে তা পল্লবিত বৃক্ষে পরিণত হবে।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক
প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান বৈশ্বিক বাস্তবতায় এখন কতটা গুরুত্ববহ, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ
নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সবারই প্রত্যাশা বাংলাদেশ তার নতুন গন্তব্যে
পৌঁছবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য সংস্কার কার্যক্রম শেষ করবে। প্রশ্নমুক্ত,
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন একটি দৃষ্টান্তযোগ্য ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হিসেবে ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে।
আমরা মনে করি দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে সব স্তরের ব্যবস্থা প্রক্রিয়ার ক্ষত উপশম করে
গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধিকতর ঔজ্জ্বল্যের জন্য তো বটেই, একই সঙ্গে দেশবিদেশের
নানা মহল অনুসরণযোগ্য নজির খুঁজে পাবে। চলমান নানামুখী বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে অর্থনৈতিক
সক্ষমতার দিকে দেশের যাত্রা সঙ্গত কারণেই প্রতিকূলতার মুখে রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে
অর্থ পাচার, ব্যাংকসহ গোটা আর্থিক খাতে লুটপাট ও বহুমাত্রিক কদর্যতার ছায়া অর্থনীতির
ওপর পড়েছে। এ থেকেই সৃষ্ট ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টানাপড়েন ইত্যাদি। মূল্যস্ফীতির
টানা কশাঘাত জনজীবনে এখনও অসহনীয়তা জিইয়ে রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিংবা জননিরাপত্তা
নিয়েও প্রশ্ন আছে। কিন্তু আমরা মনে করি, দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি সরকার যদি
জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার মতো বিষয়গুলো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অগ্রভাগে রাখে, তাহলে
সুশাসন নিশ্চিত হওয়ার পথ সুগম হবে। আমরা আরও মনে করি, দেশ-জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতির পথ
মসৃণ করতে এবং অর্থনৈতিক বিকাশের পরিস্ফুটন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ে যেতে সর্বাংশে গুরুত্বপূর্ণ
হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আগেই বলেছি, সুশাসন নিশ্চিত হলে শুধু বিদ্যমান সংকটের
নিরসনই নয়, কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নও বাস্তবায়ন সহজ হয়ে উঠবে। আমরা আশা
করব, জনস্বার্থ ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
অর্জনের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোযোগ আরও গভীর করা হবে।
নতুন বছরে আমরা
শুধু নতুন স্বপ্নযাত্রার কথাই বলব না, একই সঙ্গে এর বাস্তবায়নের ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট
দায়িত্বশীল সব পক্ষের দৃঢ়তার কথাও স্মরণ করিয়ে দিই। ঘাত-প্রতিঘাত, অর্জন-অনর্জন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
সবকিছুর হিসাব কষে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের ব্যাপারেও
সমভাবেই গুরুত্ব আরোপ করা হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, যে সংকটে আমরা নিপতিত ছিলাম এবং
নতুন যে প্রত্যয় ধারণ করে নতুন বছরে পদাপর্ণ করলাম, এর লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্র বিনির্মাণের
কর্মযজ্ঞ সুসম্পন্ন হবে। দেশের অদম্য অগ্রযাত্রার পথে যা কিছু প্রতিবন্ধক তা প্রতিহতকরণে
রাজনৈতিক-সামাজিক সব শক্তির যূথবদ্ধ প্রয়াস জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার জনআকাঙ্ক্ষার
ফসল। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রত্যাশা, অনাচার-দুরাচার, দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতিসহ জনজীবনের
জন্য বৈরী সবকিছুর সুরাহা এমনভাবে করতে হবে যাতে কোনো মানুষই অধিকারবঞ্চিত না থাকে।
বৈষম্যের ছায়া সরিয়ে সাম্যের আলো ছড়িয়ে মানুষের অধিকারের মাঠ সমতল করে স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা
নিশ্চিত করার পথ সুগম করতে হবে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে
বর্তমান বিশ্ব নানামুখী সংকটে নিপতিত। আমরা আশা করব, শান্তিময় বিশ্ব গড়তে সবার মাঝে
শুভবোধের উদয় ঘটবে। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সড়ক ধরে এগোতে হবে যাতে
তা নতুন স্বপ্নযাত্রার পথে শক্তি সঞ্চার করে। দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মতপার্থক্য
থাকতে পারে এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমনটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মনে
রাখতে হবে, অনৈক্য কিংবা মতপার্থক্য যেন দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। সব প্রত্যাশাই পূরণ
হোক অঙ্গীকারের সড়ক ধরে। আমাদের পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, হকার ভাই-বোন ও শুভানুধ্যায়ী
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। শান্তি ও স্থিতিশীলতাই সবার মুখ্য প্রত্যাশা।