× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

স্বাগত ২০২৫

থার্টি ফার্স্ট নাইটের সঙ্গে পহেলা বৈশাখের পার্থক্য

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:০১ এএম

আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:১৪ এএম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বাঙালির নববর্ষ অন্য রকমের, মধ্যরাতের নয়, অতিপ্রত্যুষের; সূর্য ওঠার আগের। একুশে ফেব্রুয়ারিও তা-ই ছিল, দিনটিরও সূচনা হতো প্রভাতফেরি দিয়ে; মধ্যরাতে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন শুরু হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। বাঙালিপনার দিক থেকে বিচার করলে রাত ১২টা ১ মিনিটে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন শুরু করাটা অপ্রত্যাশিত বটে। উদযাপনের এই নতুন পদ্ধতি থেকে বোঝা গেছে স্বাধীনতার পর স্বাধীন দেশের গতি কোন দিকে হবেÑ পূর্বমুখী নাকি পশ্চিমমুখী। পূর্বে সকাল, পশ্চিমে মধ্যরাত। মধ্যরাতে একুশের উদযাপন যে কেমন ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে, মেয়েদের পক্ষে, সেটাও প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু পহেলা বৈশাখকে নিশ্চয়ই রাতের ব্যাপারে করা যাবে না। থার্টি ফার্স্ট নাইটকে যেমনভাবে করা হয়ে থাকে।

বাঙালি বাঙালিকে না বাঁচালে কে বাঁচাবে? এ অত্যন্ত সত্য কথা। খাঁটি কথা। কিন্তু খুব সত্যÑ বাঙালি যে বাঙালিকে বাঁচাবে, তারই-বা ভরসা কোথায়? কখনও কখনও বিদ্যমান পরিস্থিতিই বলে দেয়Ñ প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের শত্রু ভেতরে ভেতরে। হ্যাঁ, বাঙালি বাঙালিকে অবশ্যই বাঁচাতে পারবে যদি সে হয় ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু মুশকিল তো সেখানেই। ঐক্যবদ্ধ যে হবে তার ভিত্তিটাই-বা কোথায়? পুঁজিবাদী মানুষকে ভাগ করে দিয়েছে শোষক-শোষিতে। শোষক ও শোষিত এক হয় কী করে? কী করেইবা তারা এক ভাষা বলবে, জামা-কাপড় পরবে একই ধরনের? ওইখানেই তো কাটা পড়ে ঐক্যরে গোড়া। ক্রমাগত বাড়ছে অনৈক্য। ধনবৈষম্য বাড়ছে সমাজে। বৈষম্য যে শুধু অর্থনৈতিক তাও তো নয়; শিক্ষা, চিকিৎসা সবক্ষেত্রেই বৈষম্য। বৈষম্যের ছায়া সমাজে ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে এবং তাতে বিভক্তির দাগও মোটা হচ্ছে। বাঙালিত্বকে রক্ষা করতে হলে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে দেশের সব মানুষকে। সাংস্কৃতিক চেতনার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের স্তরে স্তরে। সাংস্কৃতিক চেতনার আলোই পারবে মানবতার বোধ পুষ্ট করতে এবং একে অন্যের কাছে আনতে। তাই সর্বাগ্রে চাই ঐক্য। আর এই ঐক্যের জন্য প্রয়োজন নতুন এক সমাজ গঠনের।

থার্টি ফার্স্ট নাইটের সঙ্গে পহেলা বৈশাখের এই ব্যবধানটা একেবারেই মৌলিক। সকালকে আমরা সকালেই চাই, গভীর রাতের অন্ধকারে নয়। উদযাপনের পদ্ধতিতেও পার্থক্য রয়েছে। পহেলা বৈশাখের গান আর ইংরেজি নববর্ষের গান কখনই এক রকম হবে না। হওয়া সম্ভব নয়। লোকগুলোও আলাদা। পোশাক-পরিচ্ছদ তো বটেই। তবে এটা অবশ্য ঠিক যে, যারা থার্টি ফার্স্ট নাইটের অন্ধকারকে আলোকিত করে আমোদ-আহলাদ করে থাকে, তাদের সকলের না হোক কারও কারও পিতামাতা এখনও পহেলা বৈশাখে কিছু দূর গাড়িতে গিয়ে কিছুটা পায়ে হেঁটে রমনা বটমূলে উপস্থিত হন। অপর দিকে থার্টি ফার্স্ট বেশ রহস্যময়, উদযাপনকারীদের মতোই। তুলনায় পহেলা বৈশাখ খোলামেলা।

তবে আশঙ্কা করাটা মোটেই অমূলক নয় যে, যতই দিন যাবে ততই আমরা অধিক মাত্রায় পশ্চিমমুখো হব, আমরা মানে আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করা মাথারা, তারাই তো সব। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জের কথা এখন খুব ধুমধামে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা কী তা বলা হচ্ছে না। কম্পিউটার প্রযুক্তি, ইনফরমেশন টেকনোলজি, এসবের কথা শুনি, কিন্তু আসলে চ্যালেঞ্জটা যে অন্য কিছুর নয়, সরাসরি যে বাজারের, সে কথাটা শুনি না। বিশ্বায়ন অর্থ হচ্ছে বিশ্বের দিক থেকে বাজার দখল এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে সেই বাজারের সর্বগ্রাসী প্লাবনের মুখে আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে আত্মরক্ষা ও নিজের পায়ে দাঁড়ানো। নানান প্রচারণা ও প্রতারণার সাহায্যে এই সত্যটাকে অন্তরালবর্তী করার চেষ্টা চলছে।

তথাকথিত উন্নত বিশ্ব তাদের পণ্য আমাদের দেশে অবাধে পাঠাবে, আকাশপথে পণ্যের মাহাত্ম্য প্রচার করবে, দরকার থাকুক না-থাকুক বাধ্য হব সেসব পণ্য কিনতে। আমাদের উৎপাদকরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না, ক্রমান্বয়ে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমরা পরিণত হব ক্রেতায় ও দোকানদারে এবং সেবকে। আর আমাদের লোকেরা যাতে ওসব জিনিস কিনতে পারে তার জন্য ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। ম্যাক্রোক্রেডিট ও মাইক্রোক্রেডিট দুটোই আসবে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সহযোগিতার অভাব ঘটবে না।

কেবল যে ভোগ্যপণ্য কেনা হবে তা নয়, সমরাস্ত্রও কেনা হতে থাকবে। বিশ্বব্যাংক যা চাইবে বাংলাদেশ তা-ই করবে। আমলারা চাকরির ও অন্যান্য সুবিধার লোভে বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে ব্যস্ত থাকবেন। গ্যাস, তেল ও কয়লা বাংলাদেশের বড় সম্পদ, সে সম্পদও বিদেশি কোম্পানিগুলো অনুসন্ধান, উত্তোলন ও বিতরণের দায়িত্ব নিয়ে হস্তগত করে ফেলবে। আমাদের শাসক শ্রেণি সমানভাবে আত্মস্বার্থ পুষ্টকরণে ব্যস্ত এবং সে কারণে বিদেশি কর্তাদের সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট; কাজেই গ্যাস, তেল ও কয়লা বাংলাদেশের জন্য সম্পদ না হয়ে যে বিপদের কারণ হতে পারে, এই আশঙ্কটা মোটেই অমূলক নয়। অতীতেও এমনটা ঘটেছিল। বাংলার সম্পদই বাংলাকে বিপদে ফেলেছিল; দেশ চলে গিয়েছিল বিদেশিদের দখলে। এবারও সেটাই ঘটতে পারে। যদি আমরা সতর্ক না থাকি।

বিদেশি পণ্য অবাধে আসছে, কিছু আসছে বৈধ পথে, তার চেয়েও অধিক পরিমাণে আসছে অবৈধ উপায়ে, চোরাচালানের মধ্য দিয়ে। সেই সঙ্গে আকাশপথে চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সামনে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির যত বিকৃতি রয়েছে, আমরা নিজের খরচায় এসব নোংরা ও ক্ষতিকর বস্তু নিয়ে আসছি। ভাবছি উপকার হচ্ছে। বিশ্বায়নের এও একটি পথ। বাজার দখল করবে, মগজও দখল করবে। বাজার দখলও মগজ দখলই একপ্রকারের এবং মগজ দখল বাজার দখলকে চিরস্থায়ী করার পদ্ধতিও বটে। উপায়টা তাহলে কী? কীভাবে বাঁচব আমরা বিশ্বায়নের এই আগ্রাসন থেকে? কী করে রক্ষা করব বাঙালির পহেলা বৈশাখের সকালকে, থার্টি ফার্স্ট মিডনাইটের নিষ্ঠুর গ্রাস থেকে? জবাবটা নিহিত রয়েছে ওই শেষ প্রশ্নটির ভেতরেই। দাঁড়াতে হবে পহেলা বৈশাখের পক্ষে। দৃঢ়তার সঙ্গে এবং ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকারে।

তার মানে কি এই যেÑ আমরা বিশ্ববিমুখ হব? পরিণত হব কুয়োর ব্যাঙে? না, মোটেও তা নয়। বিশ্বের যেখানে যা কিছু মহৎ আছে আমরা নেব। অবশ্যই নেব, কিন্তু নিতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, বৃক্ষের মতো এবং বৃক্ষের আদর্শে; পরগাছার মতো নয়, তার আদর্শ অনুসরণ করেও নয়। কেবল আমরা কেন, সারা বিশ্বেই আজ ওই ধ্বনি উঠেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হওয়ার কথা জাতিসংঘের চেয়ে শক্তিশালী ও দুর্ধর্ষ প্রতিষ্ঠান, সে পথেই এগোচ্ছিল। কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণ ঘটে গেল। তার সম্মেলন উপলক্ষে, আর সেটা ঘটল অন্যকোথাও নয়, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই। সিয়াটোলে। অপ্রত্যাশিত বটে, কিন্তু ঘটনাটা অস্বাভাবিক নয়। কেননা বিক্ষোভ আছে, বিক্ষোভ জমছে। এই বিক্ষোভেরই একটা ভিন্ন রকমের আত্মপ্রকাশ হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনে আমরা যতই থার্টি ফার্স্ট নাইটের উপাদান সংযুক্ত করার চেষ্টা করি, এ দিবস মাতৃভাষা দিবসই আসলে; সে হিসেবেই বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বীকৃতির পেছনে রয়েছে এই বোধ যেÑ প্রতিটি জাতিসত্তারই আছে নিজের মতো করে এবং নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে থাকার অধিকার।

আমরা এখনও বছর গণনা বৈশাখের হিসাবে করি না; করি জানুয়ারির হিসেবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বটেই, এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও! তবে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষক ও গ্রামের বাসিন্দারা অবশ্য বৈশাখকে খুবই চেনে। কেননা বৈশাখ তাদের শ্রম, উৎপাদন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত। গুরুত্বপূর্ণরা আজ প্রকৃতি ও পরিবেশে থাকে বিচ্ছিন্ন, গুরুত্বহীন মানুষেরা নয়। গুরুত্বহীনদের কাছে বৈশাখ খুব প্রখর ও জাগ্রত। সেই সঙ্গে সংস্কৃতিই তাকে ঐক্যবদ্ধ করে তার চারপাশের মানুষের সঙ্গে। ওই যে নিজস্ব সত্তা, তাকে বাঁচানোর তাগিদ এবং পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধতা ওইখানেই আছে মানুষের শক্তি, যে শক্তি আগ্রাসনকারীদের যুগে যুগে হটিয়ে দিয়েছে, ভবিষ্যতেও দেবে। পহেলা বৈশাখ সাংস্কৃতিক। এজন্যই তার পক্ষে সম্ভব নয় অরাজনৈতিক হওয়া। তার রাজনীতি প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, অর্থাৎ নববর্ষ যাতে সব মানুষের হয় এবং প্রত্যেকের জীবনে আনন্দ ও অগ্রগতি নিয়ে আসে, সেই লক্ষ্যে এগোনোর। পহেলা বৈশাখের শত্রু হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ। এ দুই মানব সভ্যতারও শত্রু বটে। পহেলা বৈশাখ যে আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশÑ এই সত্য এড়ানোর চেষ্টা যে বা যারাই করবে, তারা আর যাই হোকÑ মনেপ্রাণে মোটেই বাঙালি নয়।

স্বীকৃতিটি সতর্ক করে দিচ্ছে এই বলে যে, বিশ্বায়ন যেন বাড়াবাড়ি না করে। সবকিছুকে যেন এক মানদণ্ডে বিচার না করে। পুঁজিবাদের নিজস্ব রাষ্ট্রভাষা রয়েছে, সে ভাষা সকলের মাতৃভাষা নয়। কিন্তু সকলের মাতৃভাষা থাকবে। তাকে বাঁচাতে হবে। থার্টি ফার্স্ট নাইট নয়, পহেলা বৈশাখের কাছেই যেতে হবে, যে পহেলাতে একুশে ফেব্রুয়ারিও অন্তর্ভুক্ত বটে। পহেলা বৈশাখের যে স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা, একুশে ফেব্রুয়ারি তাকেই রক্ষা করতে চেয়েছে, আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এবং ওই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে অনিবার্য করে তুলেছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।

  • ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা