স্বাগত ২০২৫
মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৭ এএম
মযহারুল ইসলাম বাবলা
খ্রিস্টাব্দের প্রতিটি বছর পেরিয়ে নতুন বছরে আমরা পদার্পণ করি। শতাব্দী থেকে শতাব্দীজুড়ে প্রতি বছরান্তে নতুন বছরে প্রবেশ চিরায়ত ঘটনা। এ পুরাতন বছর বিয়োগে আমাদের জীবন থেকে একটি বছর যে খসে গেল, সেটিও কি গুরুত্বপূর্ণ নয়! আমাদের অতীত আর বর্তমানের জীবনাচারে উৎসব-পার্বণ, আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করে আসছি। আমাদের সামাজিক জীবনে উৎসব-পার্বণের আধিক্য এবং মাত্রা ব্যাপক হারে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এর পেছনে অন্তর্নিহিত কারণ যে নেই, তা কিন্তু নয়। আমাদের উৎসব মুখে ঠেলে দেওয়া, সামাজিক জীবনে নতুন নতুন উৎসব অনুষ্ঠান যুক্ত-সংযোজন করার মধ্য দিয়ে ভোগবাদিতার দীক্ষা দেওয়ার নানা প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। সেটা পুঁজিবাদী অপতৎপরতা বলেই অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়। অথচ এমন সব উৎসব আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে জড়ানো হয়েছে যার অস্তিত্ব অতীতে আমরাই দেখিনি।
৩১ ডিসেম্বর নিয়ে স্বাধীনতার আগে এবং পরেও মাতামাতির এত তীব্র প্রবণতা আমাদের দেখার সুযোগ হয়নি। অত্যন্ত সীমিত পরিসরে এবং অনাড়ম্বর আয়োজন-অনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তো এ দিনটি মাত্রাজ্ঞানহীন পর্যায়ে উপনীত। যেন ৩১ ডিসেম্বর পালন মানেই সীমাহীন স্বেচ্ছাচারী আর তথাকথিত অবাধ স্বাধীনতা। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন বিজাতীয় সংস্কৃতিতে নিজেদের বিলীন করে পালিত হয় থার্টি ফার্স্ট নাইট। যার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সামান্যতম যোগসূত্রতা ছিল না এবং নেই। তবে খ্রিস্টাব্দের সাল-তারিখের ভিত্তিতেই আমাদের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক জীবনে কিছু দিবস আমরা অতীতের ধারাবাহিকতায় পালন করে আসছি। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ চাঁদ দেখার ভিত্তিতে পালিত হয়ে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারিও খ্রিস্টীয় তারিখ অনুসরণে পালিত হয়। একমাত্র পহেলা বৈশাখের দিনটি ছাড়া জাতীয়ভাবে দ্বিতীয় একটি দিন নেই যেটি বঙ্গাব্দের সাল-তারিখের ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে পালিত হয়।
নতুন বছর এলে আমরা শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি অপূরণীয় স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করি। এবং সেটা প্রতি বছরান্তে নতুন বছর এলেই যথানিয়মে প্রত্যাশা করে থাকি। কিন্তু নতুন বছর আমাদের প্রত্যাশাপূরণের বারতা নিয়ে আসে না। গতানুগতিক বছর পেরিয়ে বছর আসা-যাওয়া করে কিন্তু আমাদের সামষ্টিক জীবনে কোনো পরিবর্তন সূচিত হয় না। ৫ আগস্টের পর আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখছি না। বরং ক্ষমতার হাতবদল ভিন্ন জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের কোনোরূপ সম্ভাবনা দৃশ্যমান নয়। আমাদের জীবন অভিজ্ঞতায় একই বৃত্তে আমরা আটকা পড়ে আছি। ইতিবাচক কিছু ঘটেছে বলে অনুমান করতে পারব না। পরিবর্তন তো পরের কথা, নেতিবাচকের মাত্রাই ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেন এটাই আমাদের সামষ্টিক জীবনের অদৃষ্টের লিখন। শান্তি আসেনি কিন্তু স্বস্তিও যেন পালাতে উদ্যত।
আমাদের পূর্বপুরুষরা নানা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন অতীতকে বর্তমানের সঙ্গে বিবেচনা করে। ব্রিটিশ আমলের প্রশংসা করতেন পাকিস্তানি আমলের তুলনা বিচারে। আনা-পয়সায় বেচাকেনার অবিশ্বাস্য হরেক কাহিনী বলে বলে অতীতের সুখস্মৃতি কথা বলতেন। অল্প রোজগারে অধিক চাহিদা পূরণ হলেও এখন অতীতের তুলনায় বেশি রোজগার করেও অভাব যেন পিছু ছাড়ে না। ব্রিটিশ আমলে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর স্বল্পমূল্যে কেনার হরেক কথা। অথচ পাকিস্তানি আমলে তাদের নাকাল হতে হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলের আইনকানুন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজের নানা চিত্র তুলে ধরতেন পাকিস্তানি আমলের তুলনা বিচারে। শাসনামলের পরিবর্তনে তাদের অপ্রাপ্তির খতিয়ান শুনে ভাবতাম পাকিস্তানি আমলের পরিসমাপ্তিতে নিশ্চয় সুদিন আমরা ফিরে পাব। কেননা যে আকাঙ্ক্ষায় বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টিতে এবং পাকিস্তানের একাংশ থেকে দ্বিজাতিতত্ত্ব আস্থায় নিয়েছিল। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আশাহতের ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা ব্রাত্যে পরিণত হয়। নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রক্ষমতা পাঞ্জাবিদের অধীনে চলে যায়। বাঙালি মুসলমানরা আরও পশ্চাৎ অভিমুখে নিজেদের আবিষ্কার করে ঘুরে দাঁড়াতে কালক্ষেপণ করেনি। পাকিস্তান অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্ত্বের মোহমুক্তি দ্রুতই ঘটেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলেও ছিল সামষ্টিক মুক্তির স্বপ্ন। তেইশ বছরের পাকিস্তানি আমলের অবসান হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাভূত করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও দেশবাসীর স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা অপূরণীয় রয়ে যায়। তাই এখনও অনেকে পাকিস্তানি আমলের সঙ্গে বাংলাদেশ আমলের তুলনামূলক বিচার করে হতাশা ব্যক্ত করেন। অতীত আমলের জীবনাচারের সুখস্মৃতির কথাও বলেন। স্বাধীন দেশে জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তি আসেনি, ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা কতিপয়ের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ দেশের শাসকশ্রেণির দ্বারা শোষণ-বঞ্চনার শিকার। এ যেন অনিবার্য ধারাবাহিক। হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় বিভাজনের পাকিস্তান কিংবা বাঙালি-অবাঙালি বিভাজনের বাংলাদেশ কোনোটি এ দেশের মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। এর অন্তর্নিহিত কারণ কী? প্রধানত কারণ বৈষম্য। অনিবার্যরূপে শ্রেণিবৈষম্য।
সব নাগরিকের অধিকার ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে চরম বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থা টিকে থাকা এবং ক্রমেই শক্তিশালী হওয়া। ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ কোনো আমলেই মানুষে মানুষে শ্রেণিবৈষম্য কমেনি বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে জাতির যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সে ঐক্য আর থাকেনি। বিশেষ শ্রেণি, সংখ্যায় যারা ক্ষুদ্র অংশ তারা ধনী হওয়ার সুযোগে ধনী হয়েছে। গরিব আরও গরিব হওয়ার পথে নেমেছে। সামাজিক এ শ্রেণিবৈষম্য তীব্র হয়ে পড়েছে বলেই অতি সহজে পরিবারে পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। ভাই-বোন থেকে নিকট আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যকার সম্পর্ক থাকা-না থাকাও নির্ধারিত হয়ে পড়েছে শ্রেণিগত অবস্থানের ভিত্তিতে। আমাদের শ্রেণি বিভক্ত সমাজে মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে শ্রেণিবৈষম্যের কারণেই। শ্রেণিবৈষম্যের অবসানেই সমষ্টিগত মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ সম্ভব। অন্য কোনোভাবেই সেটা সম্ভব হবে বলে অনুমান করতে পারি না।
পাকিস্তানি তেইশ বছরের শাসনামলের প্রচুর বিচার-বিশ্লেষণ, ইতিহাস-গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছেও। কিন্তু পাকিস্তানি আমলের প্রায় দ্বিগুণ সময়ের বাংলাদেশ আমলের বিচার-বিশ্লেষণ হয়েছে কি? হয়নি। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমাদের দুরবস্থার বিশ্লেষণ-গবেষণা হয়নি। কেবল স্বাধীনতা প্রাপ্তির স্বস্তির ঢেঁকুর তুলেছি। অনুসন্ধান করে বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে পারিনি। যারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে পাশে দাঁড়িয়ে জাতিকে মুক্তির দিশা দিয়ে নতুন দিনের পথনির্দেশনা দেবেন; তাদের সংখ্যা কমে কমে এখন আঙুলে গোনা যাবে। আর বুর্জোয়া রাজনীতিকরা? তারা তো নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে রাজনীতি নামক পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েছে। রাজনীতি এখন পেশা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। যারা প্রকৃত অর্থে জনগণের ভাগ্য ফেরাতে চান, বদলাতে চান সমাজ ও রাষ্ট্র, তারা পরস্পর অনৈক্য বিভাজনে এতটাই বিভক্ত যে তারা হয়ে পড়েছেন জনবিচ্ছিন্ন। তাদের ঐক্যই একমাত্র আলোর দিশা। কেননা তাদের পক্ষেই কেবল সম্ভব নিজেদের ঐক্যের পাশাপাশি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে বিদ্যমান ব্যবস্থা বদলে শাসকশ্রেণিকে পরাভূত করে জনগণের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তি নিশ্চিত করা। জনগণকে ধোঁকা দিয়ে দিয়ে বোকায় পরিণত করে গত ৫৩ বছর যারা শাসকরূপে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন এবং আছেন, তারা কেউ জনগণের প্রকৃত বন্ধু নন। নির্ভেজালরূপে শোষক। বিগত ৫৩ বছরের বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন নির্বাচিত-অনির্বাচিত কোনো সরকারই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দেয়নি-এ অভিযোগ নানা মহলের এবং তা নতুনও নয়।
আমরা অতীত আমলের সুখ্যাতি বর্ণনা করি কেন? নিশ্চয় অপ্রাপ্তির হতাশায়। বর্তমান আমলের তুলনা বিচার করে অতীত আমলের সুখশান্তির স্মৃতি রোমন্থন করি এ কারণে যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাভূত করে বিজয় অর্জন করেও সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছি। সেই ব্যর্থতার আড়ালে অতীত রোমন্থনে বর্তমানকে ভুলতে চাই। কিন্তু বর্তমানই দৃশ্যমান বাস্তবতা। একে এড়ানোর উপায় নেই এবং অসম্ভব। আমাদের সামষ্টিক স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা এবং সর্বোপরি বৈষম্য নিরসনের একমাত্র উপায় বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন জনস্বার্থবিরোধীদের পরাভূত না করা অবধি বছর ঘুরে বছর আসবে-যাবে, আমাদের জীবনের আয়ুষ্কাল খসে পড়বে কিন্তু আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ হবে না। সেজন্য জনগণের অধিকার সচেতনতার পাশাপাশি জনগণের ঐক্য ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। জনগণের ঐক্যেই অতীতের সব জাতীয় অর্জন সম্ভবপর হয়েছে। রাষ্ট্র বিনির্মাণে দেশপ্রেমিক সবার যূথবদ্ধ প্রয়াস গতিশীলতা পাবে এও প্রত্যাশা। আগামীতেও অনুরূপ ঐক্যে সমষ্টিগত মানুষের মুক্তি অর্জন সম্ভব বলেই স্বীকার করি।