মো. অহিদুর রহমান
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:১৩ পিএম
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:১৪ পিএম
কৃষিজমি বাড়ছে না। বাড়ছে মানুষ, ঘরবাড়ি, প্রতিষ্ঠান, ইটখোলা, টাওয়ার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভাগ হচ্ছে জমি, তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট, রেললাইন। জমি হারাচ্ছে উর্বরাশক্তি। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কমছে জমি, কমছে জলাভূমি। বিলুপ্ত হচ্ছে বন, গোচারণভূমি। পাহাড়ি ঢলে জমিতে পড়ছে বালি। বাংলাদেশে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এভাবে কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলতে থাকলে ২০৫০ সালে কোনো কৃষিজমি থাকবে না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশের আবাদযোগ্য জমি ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ২৬৬ হেক্টর এবং আবাদযোগ্য অনাবাদি জমি ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৫১ একর বা ৯১ হাজার ২৭৭ হেক্টর। ভূমি সংস্কারে নিয়োজিত অলাভজনক সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণা বলেছে, বাংলাদেশে মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৪৪ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ বনভূমি, ২০ দশমিক ১ শতাংশ স্থায়ী জলাধার, ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট রয়েছে। বাকি ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ জমি কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয়।
দেশের বিপুল পরিমাণ জমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। এভাবে চললে একদিন হয়তো চাষাবাদের জন্য জমি ফুরিয়ে যাবে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ এখনও কৃষিনির্ভর। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও নির্ধারিত হয় কৃষি উৎপাদনের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর। নতুন বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট-অবকাঠামো নির্মাণ, ইটভাটা, কলকারখানা, নগরায়ণের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ, ইটভাটার জন্য টপসয়েল ব্যবহার, ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে বেশি। বর্তমান হারে ভূমির অবক্ষয় চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে কোনো কৃষিজমি থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে খোদ সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর। সংস্থাটির মহাপরিচালকের বরাতে প্রকাশ, প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে কোনো কৃষি জমি থাকবে না। জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে না জমি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ নানা কারণে প্রতি বছর দেশের প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।
জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি, ২০১০ এবং কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন, ২০১০ অনুসারে কৃষিজমি কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো কৃষিজমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্পকারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না উল্লেখ করে একটি আইন আছে। অথচ সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের কৃষিজমি বিলুপ্তির প্রবণতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সাল-পরবর্তী ১২ বছরে দেশে প্রতি বছর ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। শুধু অবকাঠামো নির্মাণ কাজের কারণে প্রতি বছর ৩ হাজার হেক্টর জমি বিলীন হচ্ছে। পাশাপাশি উচ্চহারে জনসংখ্যা ও তাদের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু জমির পরিমাণ হ্রাসের জন্য কৃষি, বন ও জলাভূমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। কৃষিজমি জমি আছে বলেই স্বাধীনতার ৫৩ বছরে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব হয়েছে। কৃষির এ শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে অন্যসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন সহজতর হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা আর অস্থিরতার মধ্যেও দেশকে অনেকটা স্বাভাবিক রাখছে কৃষি। তাই জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে জাতীয় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও নীতিমালা জরুরি। কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহারের প্রবণতা কঠোরভাবে রুখতে হবে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষিজমির সুরক্ষা ব্যর্থ হলে টিকে থাকা কঠিন হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিই কৃষিজমি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। দিনদিন জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঘরবাড়ি। যার অধিকাংশ তৈরি হচ্ছে কৃষিজমিতে। এ ছাড়া জনসংখ্যা বাড়ার প্রভাব পড়ছে অন্যান্য ক্ষেত্রে।
কৃষিজমি কমে আসার তথ্যটি অশনিসংকেতও বলা যায়। পরিবেশবিদরা অনেক আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার। নীতিনির্ধারকরাও এখন উচ্চেঃস্বরে কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু কাজের কাজ তেমন একটা হচ্ছে না। কৃষিজমি রক্ষায় ‘কৃষিজমি (যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ) আইন ২০২২’ নামে একটি বেসরকারি বিল গ্রহণ করা হলেও তা এখনও আইনে পরিণত হয়নি। কৃষিজমি সুরক্ষায় পরিকল্পিত নগরায়ণ ও গ্রাম ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামের গোহাট (গরু, মানুষ ও উৎপাদিত ফসল পরিবহনের জন্য যে গ্রামীণ রাস্তা), পাহাড়-বন সুরক্ষিত রাখতে হবে, আলোচ্য আইনটিতে (প্রস্তাবিত কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন) অপরাধীদের বিচার কোন আদালতে হবে তার উল্লেখ নেই। এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের (যা অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে সর্বস্তরের মতামতের জন্য) একটি জায়গায় ‘অনুর্বর ভূমি’ ও ‘উর্বর ভূমি’র উল্লেখ আছে। এ উর্বর এবং অনুর্বর ঠিক করবে? সেই কর্তৃপক্ষের উল্লেখ নেই। এ আইনের ধারা ৪-এর ১ (খ) এবং ১(ঙ) ধারা সংশোধন করতে হবে। সরকারিভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনতে হবে। ভূমির মালিকানা সুষ্ঠুভাবে নিরূপণ করতে হবে।
দক্ষ ও অভিজ্ঞদের দিয়ে অতিসত্বর একটি নির্ভুল ভূমি জরিপ করতে হবে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহার করা যাবে না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। কৃষিজমিতে কৃষি ফসল বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে প্রাকৃতিক কৃষি (মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রেখে, নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে যে কৃষি) উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। নদী-খাল-বিলসহ সব ধরনের জলাশয় সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে কৃষিজমি সুরক্ষা আইনের প্রধান প্রধান ধারা এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের কৃষি অফিসারের নম্বরসংবলিত একটি করে বিলবোর্ড স্থাপন, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য আলাদা একটি সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করতে হবে। দেশ থেকে অর্থ পাচার হলে এ প্রভাব কৃষিজমিসহ সব ক্ষেত্রেই পড়ে। তাই অর্থ পাচার রোধ করতে হবে। টপসয়েল বিক্রি করা বন্ধ করতে হবে। কৃষিজমি নষ্ট করে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। কৃষিজমির প্রাণরক্ষায় গতিহীন, মরে যাওয়া এবং হাজামজা সব ছোট নদ-নদী, খাল পুনঃখননের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি খাসজমি, জলমহাল বন্দোবস্তে প্রকৃত ভূমিহীনদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারি কৃষি খাসজমি কোনোভাবেই বিক্রি করা চলবে না। পতিত জমি কৃষিজমিতে পরিণত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ নিতে হবে। কৃষিজমি সুরক্ষার ব্যাপারে যেমন সরকারের যথাযথ তৎপরতা দরকার তেমনি মানুষেরও এ নিয়ে ভাবতে হবে।