সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:২৬ পিএম
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় ২৭ ডিসেম্বর সকালে যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেই মর্মস্পর্শী ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা না বলে বিশৃঙ্খলার ভয়াবহ প্রতিফল বলা যায়। টোল প্লাজার সিসিটিভিতে ঘটনার যে ভিডিওটি ধরা পড়েছে তাতে দেখা গেছে, ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় মাওয়ামুখী লেনে একটি মোটরসাইকেল টোল পরিশোধের জন্য দাঁড়িয়েছিল। এর পেছনে দাঁড়ানো একটি মাইক্রোবাস। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেখানে কাতারভুক্ত হয় আরও একটি প্রাইভেটকার। অল্প কিছু সময় পরই বেপরোয়া গতিতে ব্যাপারী পরিবহনের একটি বাস টোল প্লাজার দিকে আসতে থাকে। ওই বাসটি প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলকে দুমড়ে-মুচড়ে টোল প্লাজার বাইরে নিয়ে যায়। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর নানা মহল থেকে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উঠে আসছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, এক্সপ্রেসওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলেও শৃঙ্খলার কোনো বালাই নেই। ২৮ ডিসেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ বলা হয়েছে, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় মৃত্যু মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।
এর মাত্র কয়েক দিন আগে মুন্সীগঞ্জের এক্সপ্রেসওয়েতে যথাযথ তদারকির অভাবে এবং সাইন-সংকেত সেই গতানুগতিকতার কারণে আরও একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তরফে বলা হয়েছে, ওই এক্সপ্রেসওয়েগুলোতে ক্রমাগত দুর্ঘটনার জন্য পুলিশের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা ও সড়কে সংকেত ব্যবস্থা দায়ী। স্বাভাবিক সময়ে এক্সপ্রেসওয়েতে ছোট ও মাঝারি যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারিত। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, মিনি ট্রাকসহ সব ধরনের মালবাহী যানের গতিবেগ সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার। আর মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, এই নীতিমালা কেউ মানছেন না এবং এক্ষেত্রে নেই কোনো নজরদারি-তদারকিও। এত গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ব্যবস্থাপনার চিত্র এত বিবর্ণ, তা ভাবতেও বিস্ময় লাগে, প্রশ্ন ওঠে। শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস ও হাসারা হাইওয়ে থানা সূত্রে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, চলতি ডিসেম্বরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন চালকদের নৈরাজ্যের কারণে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছে। আরও জানা গেছে, গত বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই এক্সপ্রেসওয়েগুলোতে ৬৩টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এর ফলে ১৬ জন প্রাণ হারানোর পাশাপাশি ৮০ জন আহত হন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষণে আরও উঠে এসেছে, ঘন কুয়াশার সময় হাইওয়ে পুলিশ কিছু দূর দূর অবস্থান নিয়ে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা থাকলেও তারা তা করছে না। সবচেয়ে দামি ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কে মান্ধাতার আমলের সাইন-সংকেত ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলগুলোর অজ্ঞতা ছাড়া কিছু নয়। অথচ এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ব্যয় সামান্য, প্রয়োজন শুধু যথাযথ ব্যবস্থাপনা।
২৮ ডিসেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশের ভিন্ন একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাবনায় যাত্রীসহ দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্কুটারকে ট্রাকের ধাক্কার কারণে তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, সারা দেশেই সড়কে সুশাসন কিংবা শৃঙ্খলার অভাবে মৃত্যুফাঁদের পরিসর ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। সড়ক আইন মেনে যদি চালকরা যানবাহন চালাতেন, তাহলে এমন মর্মন্তুদ পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না। আমাদের স্মরণে আছে, রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসের পাল্লাপাল্লিতে কুর্মিটোলায় প্রাণহানির পর দেশব্যাপী গণজাগরণ ঘটেছিল সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে। তৎকালীন সরকার অঙ্গীকার করেছিল ওই ঘটনার দ্রুত প্রতিবিধান নিশ্চিত করে সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই অঙ্গীকার উচ্চারণেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। দেশের সড়ক-মহাসড়ক কি ভয়াবহ মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছেÑ এর সাক্ষ্য দিচ্ছে খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএর তথ্য। তাদের তথ্য সূত্রের বরাত দিয়ে গত মে মাসের প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি মাসেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের মাসের মৃত্যু সংখ্যা! চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের সড়কে বিশৃঙ্খলা-অব্যবস্থানার কারণে ৬৩২ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং এই সংখ্যা গত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ, এও সরকারি হিসাবভুক্ত খতিয়ানেরই তথ্য।
সড়ক দুর্ঘটনা সব দেশেই কমবেশি হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো এই হার কোথাও এত ঊর্ধ্বমুখী কি না এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমরা জানি, সড়কে যানবাহন চলাচলের আইন আছে, পথচারীদের জন্যও আছে আইন। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে অন্তহীন প্রশ্ন। প্রতিবছর ২২ অক্টোবর দেশে নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়। সড়ক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিলÑ ‘ছাত্র-জনতার অঙ্গীকার, নিরাপদ সড়ক হোক সবার’। দিবস পালনের লক্ষ্য হলো, কাঠামোগত ত্রুটিবিচ্যুতি সারিয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি আইনানুগভাবে যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত করা। গত কয়েক দিন আগে, রাজধানীর কুড়িলসংলগ্ন তিনশ ফিটে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে একটি প্রাইভেটকার পিষে ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আরেকটি প্রাইভেটকার এক নারীকে পিষে মেরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় অনেক দূর তাও অনেকেরই বিস্মৃত না হওয়ারই কথা। এ রকম নজির আরও অনেক আছে। প্রায় নিত্য সংবাদমাধ্যমে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার যে চিত্র উঠে আসছে এর অধিকাংশই নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং বলা যায় কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। এর যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত হচ্ছে না বলেই সড়কে মৃত্যুফাঁদ আরও বিস্তৃত হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। কী কারণে এত বেশি দুর্ঘটনা কিংবা কী পদক্ষেপ নিলে দুর্ঘটনার হার কমানো সম্ভব, এ সবই বহুল আলোচিত বিষয়। প্রায় প্রতিটি দেশেই দুর্ঘটনাপ্রবণ বলে কিছু এলাকা চিহ্নিত করে মূলত অবকাঠামোগত এবং ভৌগোলিক স্থানগত প্রেক্ষাপটে তা চিহ্নিত হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা বলে চিহ্নিত ক্ষেত্রের পরিসরও অনেক বিস্তৃত এবং এজন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ঘাটতিও স্পষ্টতই দৃশ্যমান। সড়কে হতাহতের কারণগুলো চিহ্নিত। এর মধ্যে অন্যতম নিয়মশৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটানো, ট্রাফিক আইন না মানা, অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দ্রুতবিচারের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ-এর এক্ষেত্রে দায় অনেক বেশি। যাদের হাতে যানবাহনের স্টিয়ারিং ঘুরছে তাদের সিংহভাগই গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত এবং অভিযোগ আছে। বিআরটিএ যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়াই গাড়িচালকদের সনদ দিয়ে থাকে-এও নতুনি অভিযোগ নয়।
আমরা মনে করি, সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন জরুরি, সমভাবেই জরুরি উপযুক্ত কাঠামোগত ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যথাযথ দায়িত্বশীলতা। পরিবহন খাতে বিরাজমান নৈরাজ্য, অনিয়ম-দুর্নীতিসহ জীবনের জন্য হুমকি এর নিরসনে দায়িত্বশীলদের নিষ্ঠা ও জবাবদিহি সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে সড়ক-মহাসড়ক ভয়াবহ মৃত্যুফাঁদ হয়ে থাকতে পারে না।