× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ধর্ম ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জীববৈচিত্র্য

জোনাকির আলো জ্বালাতে হবে

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:২৪ পিএম

জোনাকির আলো জ্বালাতে হবে

জোনাকি পোকার কথা বললেই কেমন স্মৃতি যেন ভেসে ওঠে আমাদের দৃশ্যপটে। ছোটবেলায় জোনাকি পোকার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম জোনাকি পোকাগুলো কীভাবে জ্বলে। ভাবতাম আর জোনাকি পোকার দিকে ছুটে যেতাম। সেই জোনাকি পোকা এখন আর তেমন দেখা যায় না। গত মাসে একটি দৈনিকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জের মধ্যনগরের হাওর, বিল, পুকুর ও ডোবার পারে এখন আর তেমন জোনাকি দেখা যায় না। ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর অন্য একটি দৈনিকের কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার ওই প্রতিবেদক জোনাকি নিয়ে একটি প্রতিবেদনে সেখানে জোনাকি তেমন দেখতে না পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। জোনাকিদের আগের মতো এখন আর তেমন দেখা যায় না। এর সংখ্যা ক্রমেই কমে যেতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, কীটনাশক, বাসস্থান ও আলোকদূষণের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে জোনাকিরা।

পৃথিবীতে জোনাকি পোকার প্রজাতির সংখ্যা কিন্তু নেহায়েত কম নয়। পৃথিবীতে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির জোনাকি পোকা রয়েছে। শুধু সৌন্দর্যই নয়, জোনাকি পোকা আমাদের অনেক উপকারও করে। এরা মধু খাওয়ার মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটায়। ফলে খাদ্যশস্য উৎপন্ন হতে পারে। আরেকটি মজার বিষয় হলো, কোনো এলাকায় জোনাকি পোকার উপস্থিতির মাধ্যমে ওই এলাকার পানির গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অর্থাৎ যেসব এলাকার পানির গুণ ভালো, সেসব এলাকায় জোনাকি পোকা থাকে। আর যেসব এলাকায় পানির গুণ ভালো নয়, সেসব এলাকায় জোনাকি পোকা দেখা যায় না। এটা দেখেই ওই এলাকার পানির গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

জোনাকি পোকা যেকোনো বয়সেই আলো জ্বালাতে পারে। এদের লার্ভা বা ডিম থেকেও আলো জ্বলে। জোনাকি পোকার আলোকে সবচেয়ে বিশুদ্ধ আলো বলা হয়। কেননা জোনাকির আলো পুরোটা আলোকশক্তি। এ আলো কোল্ড লাইট বা শীতল আলো নামেও পরিচিত। জোনাকি পোকা মাংসাশি। ছোট শামুক, ক্রিমি ইত্যাদি এদের খাবার। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, অনেক স্ত্রী এবং পুরুষ জোনাকি পোকাও খেয়ে থাকে। জোনাকি তার শরীরে আলো জ্বালিয়ে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করে। এ আলো স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের শরীর থেকে নির্গত হয়। এর দ্বারা উভয়ে আকৃষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায় পুরুষ জোনাকিরা আলো জ্বেলে উড়তে থাকে। আর স্ত্রী জোনাকিরা লতা, পাতা, গুল্মে বসে থাকে। যখনই পুরুষ জোনাকিকে আলো জ্বালতে দেখে তখন স্ত্রী জোনাকিও আলো জ্বালিয়ে তার উপস্থিতি জানান দেয়। আরেকটি বিষয় পতঙ্গভুক প্রাণীরা খাদ্য তালিকায় জোনাকি রাখে না। কারণ জোনাকিরা এক ধরনের রক্ত নিঃসরণ করে যা বিষাক্ত ও তিতা।

জোনাকিরা সাধারণত পুকুর, নদী বা জলাধারের আশপাশে থাকে। বনাঞ্চলে পচা কাঠ ও আবর্জনায় এদের লার্ভা বেড়ে ওঠে। এরা মূলত বসবাসের জন্য উষ্ণ, আর্দ্র ও জলজ পরিবেশ বেছে নেয়। তবে বাসস্থানের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য দেখা যায়। কিছু জোনাকি পুকুর বা জলাধার বেশি পছন্দ করে। কিন্তু আমাদের দেশে জলাশয়ের পরিসর ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। একই ভাবে কমে যাচ্ছে মাঠ, বনাঞ্চল, কৃষিক্ষেত। জলাভূমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। সেসব জায়গায় ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এর ফলে জোনাকিদের প্রকৃত আবাসস্থল গড়ে উঠছে না। আলোকদূষণও জোনাকিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ। রাতের বেলা কৃত্রিম আলোর কারণে প্রজাতিটি বংশবিস্তার করতে পারছে না। কোনো স্থানের অত্যধিক কৃত্রিম আলোককে আলোকদূষণ বলা হয়। একটি গবেষণার তথ্যমতে, পৃথিবীর স্থলভাগের ২৩ শতাংশ রাতের বেলায় আলোকদূষণের দূষিত। এর ফলে জোনাকিদের বংশবিস্তারে তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। জোনাকিদের অনেক কাজই আলোক সংকেতের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন সঙ্গীকে আকৃষ্ট করা, বাসস্থান রক্ষা ও শত্রুকে সতর্ক করা। কিন্তু এসব সংকেত প্রদান করতে হলে প্রকৃতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকতে হবে। কিন্তু কৃত্রিম আলোর কারণে তারা এসব সংকেত প্রেরণ করতে পারে না। ফলে জোনাকিদের বংশবিস্তার তথা সংখ্যাবৃদ্ধিতে প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে বনাঞ্চল-মাঠ তো নেই-ই, যা-ও আছে সেসব জায়গাও কৃত্রিম আলোর দখলে। কীটনাশকের ব্যবহারও জোনাকির সংখ্যা দিনদিন কমিয়ে দিচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জোনাকির খাদ্যসংকট সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন জোনাকিদের খাবার বিভিন্ন কীট, কীটনাশকের কারণে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া জোনাকিদের লার্ভাও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মরে যাচ্ছে। জোনাকির একটি লার্ভা থেকে জোনাকি হতে সময় লাগে কয়েক মাস।

এ সময় কীটনাশক ব্যবহার করলে জোনাকির লার্ভা মারা পড়ে। একটি গবেষণার মতে, কীটনাশকের কারণে জোনাকির মৃত্যুহার ৮০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। জলবায়ুও জোনাকিদের জীবনের ওপর একটি প্রভাব ফেলে। একদিকে খরার কারণে জলাভূমি শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে জোনাকির আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। জোনাকিদের জন্য যে আর্দ্র পরিবেশ থাকা দরকার তা থাকছে না। অন্যদিকে ঝড়-বৃষ্টি-জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জোনাকিদের বাসস্থানের ওপর প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া জাপান, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে এক ধরনের ট্যুরিজম চালু আছে যেখানে জোনাকিদের আলোর খেলা দেখার জন্য মানুষ জড়ো হয়। এসব ট্যুরিজম জোনাকিদের স্বাভাবিক জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়িক কাজেও অনেক দেশে জোনাকির ব্যবহার রয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের রাসায়নিক কোম্পানি জোনাকি সংগ্রহ করে সেখান থেকে এক ধরনের রাসায়নিক উপাদান আলাদা করত। এ ছাড়া চীনেও জোনাকি ব্যবহার করে বিভিন্ন উপহারসামগ্রী বানানো হতো। এগুলো অবশ্য আন্দোলনের মুখে বন্ধ করে দেওয়া হয়। জাপান, তাইওয়ানের মতো চীনেও জোনাকি দিয়ে এগজিবিশন করা হতো। এসব এখন অনেক কমে গেছে। এ অবস্থায় জোনাকি বিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে।

জোনাকিদের বাঁচাতে হলে সর্বপ্রথম তাদের আবাসস্থল ফিরিয়ে দিতে হবে। দখল হয়ে যাওয়া বন, জলাধার উদ্ধার করতে হবে। পুকুর ও অন্যান্য জলাধার ভরাট বন্ধ করতে হবে। কেননা জোনাকিদের জন্য যে আর্দ্রপরিবেশ দরকার তা জলাধার না থাকলে সম্ভবপর নয়। আলোকদূষণ কমাতে হবে। আমরা নানা কারণে অপ্রয়োজনে আলো ব্যবহার করি। অপ্রয়োজনীয় এ কাজ বন্ধ করতে হবে। যেসব জায়গায় আলো জ্বালানোর প্রযোজন নেই, সেসব জায়গায়ও আলো জ্বালিয়ে রাখি। রাতের বেলায় এসব কৃত্রিম আলো জোনাকিদের প্রজননে মারাত্মক বাধা তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে সন্ধ্যার পর আমরা ঘরের বাইরের আলো বন্ধ করে রাখতে পারি। কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার কমাতে হবে। প্রয়োজনে কীটনাশক ব্যবহার না করে নানা রকম প্রাকৃতিক ফাঁদ ব্যবহার করতে পারি। জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করতে পারি। জোনাকির সংখ্যাবৃদ্ধিতে আমরা জাপানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। জাপানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোনাকি পোকা সংরক্ষণে নানান আলোচনা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। তারা আট সপ্তাহের কোর্সও চালু রেখেছে। এ কোর্সে জোনাকির ডিম সংগ্রহের কৌশল, লার্ভায় পরিণতকরণ, বিকশিতকরণ প্রভৃতি শেখানো হচ্ছে, যাতে কৃত্রিমভাবে জোনাকি বিস্তারে কাজ করা যায়।

  • শিক্ষক ও গবেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা