পোল্ট্রি শিল্প
মো. সুমন হাওলাদার
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:২১ পিএম
ডিম-মুরগির দাম বাড়লেই আমরা দেখছি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। গণমাধ্যম, সরকার এবং সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি ভোক্তাদের ওপর প্রভাব ফেলে। তবে প্রশ্ন হচ্ছেÑ ডিম-মুরগির দামের পেছনের প্রকৃত কারণগুলো কেন আলোচনায় আসে না? ফিড, মুরগির বাচ্চা এবং অন্যান্য উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি; যা সরাসরি প্রান্তিক খামারিদের সংকটে ফেলছে, তা নিয়ে আলোচনা হয় না কেন? ৮ থেকে ১০টি কোম্পানির হাতে জিম্মি ফিড মুরগির বাচ্চাসহ পুরো পোল্ট্রি খাত। ডিম-মুরগির বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে তারাই। তাদের হাতে প্রান্তিক খামারিদের লাভের হিসাবনিকাশ। করপোরেট গ্রুপগুলো চাচ্ছে প্রান্তিক খামারিদের হটিয়ে পোল্ট্রি বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাতে পোল্ট্রি ফিডের দাম দুই বছর আগে ৫০-৬০% বেড়ে যায়। বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়িয়েছে। এ মূল্যবৃদ্ধির বোঝা সম্পূর্ণভাবে প্রান্তিক খামারিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের যত পণ্য আছে তার ভেতরে অন্যতম ভুট্টার সয়াবিন, যা ফিড উৎপাদনের ৬০% ভুট্টা প্রয়োজন হয় ৩০% সয়াবিন প্রয়োজন হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে গত চার বছরের যার সর্বনিম্ন দাম কিন্তু অজানা কারণে বাংলাদেশের বাজারে পোল্ট্রি ফিডের দাম কমছে না। করপোরেট কোম্পানিগুলো সব সময় সরকারসহ সবাইকে লোকসানের গল্প শুনিয়ে আসতেছে। তাদের ফিডমিল হ্যাচারিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এগুলো সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত, কারণ তারা একটি ফিডমিল, একটি হ্যাচারি থেকে এখন একেকজনের ১০-২০টি ফিডমিল ও হ্যাচারি রয়েছে সরকার এগুলো খতিয়ে দেখা উচিত। তাদের লাভ না হলে কীভাবে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাড়ল এবং আঙুল ফুলে কলাগাছ হলো কী করে?
প্রান্তিক পোল্ট্রি শিল্পে চলমান অস্থিরতার অন্যতম কারণ হলো ফিড এবং মুরগির বাচ্চার অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি। যখন ডিম বা মুরগির দাম বাড়ে, তখন তা ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে, কিন্তু ফিড ও বাচ্চার দামবৃদ্ধির বিষয়ে কেন কোনো আলোচনা হয় না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। করপোরেট কোম্পানিগুলো ফিড এবং বাচ্চার দাম বাড়িয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে তুলছে এবং তাতে ফলে খামারিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বছরে ফিড ও মুরগির বাচ্চায় প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে, তবে সরকারের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। দেশের মোট ডিম ও মুরগি উৎপাদনের ৮০% সরবরাহ করেন প্রান্তিক খামারিরা। কিন্তু এখন তারা খুব চাপে আছেন। অনেক প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা তাদের সামনে। ২০২২ সাল থেকে পোল্ট্রি ফিডের দাম ৫০-৬০% বেড়েছে, যা খামারিদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার ডিমের ন্যায্যমূল্য ১০.৫৮ টাকা নির্ধারণ করলেও, খামারিরা বাজারে ৯-১০ টাকায় ডিম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং খামারিরাও ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন।
বর্তমানে ১৫-২০% বড় করপোরেট কোম্পানির হাতে পুরো পোল্ট্রি শিল্প নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফিড মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী শীর্ষ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৮ থেকে ১০টি কোম্পানি। তারা ফিড এবং মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে মুনাফা করেছে, যার ফলে প্রান্তিক খামারিরা বাজারের চাপ সইতে পারছে না। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তারা প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে। ভোক্তাদের জন্যও ডিম ও মুরগির দাম বাড়ানো উদ্বেগজনক। যদি প্রান্তিক খামারিদের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা যায় এবং সিন্ডিকেট ভাঙা যায়, তবে বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং ভোক্তারা সাশ্রয়ী দামে মানসম্পন্ন পণ্য পাবেন। ১. ফিড এবং মুরগির বাচ্চার দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নামাতে হবে। ২. প্রান্তিক খামারিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে এবং সরকারের ঘোষিত দাম বাস্তবায়ন করা নিশ্চিত করতে হবে। ৩. বড় করপোরেট কোম্পানির সিন্ডিকেট ভেঙে বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে। ৪. প্রান্তিক খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ এবং ভর্তুকি সহায়তা প্রদান করতে হবে। ৫. ফিড এবং মুরগির বাচ্চার যৌক্তিক দাম বাস্তবায়ন করতে হবে। ৬. ডিম-মুরগির বাজারে অসাধু সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। ৭. সরকারিভাবে প্রান্তিক খামারিদের ডিম-মুরগি ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে ।
প্রান্তিক খামারিদের জন্য জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা প্রয়োজন, যা তাদের সহজে নতুন করে খামার চালু করতে সহায়তা করবে। এই ঋণের মাধ্যমে তারা উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা এবং পোল্ট্রি শিল্পের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে পারবেন। সরকারি নীতি নির্ধারণী সভাগুলোয় প্রান্তিক খামারিদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। বিদ্যমান সংকট নিরসনে তা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যেখানে শুধুমাত্র করপোরেট কোম্পানির প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে, সেখানে প্রান্তিক খামারিরা অংশগ্রহণ না করলে তাদের সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। সরকারের কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে হবে এবং প্রান্তিক খামারিদের রক্ষা করতে হবে। বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে মূলত সিন্ডিকেটের কারণে, যা খামারিদের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পোল্ট্রি শিল্পের এই বিশাল সংকটে সরকারকে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। সরকার যদি বাজারের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, তবে বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে এবং প্রান্তিক খামারিরা তাদের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে।
সরকারের উচিত সিন্ডিকেটের একচেটিয়া শক্তিকে ভেঙে বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা, যাতে পোল্ট্রি শিল্পের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যায়। এই পদক্ষেপগুলো খামারি ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থ রক্ষায় সাহায্য করবে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন সব সময় সরকার এবং প্রান্তিক খামারিদের পাশে রয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য পোল্ট্রি শিল্পে স্থিতিশীলতা আনা এবং প্রান্তিক খামারিদের জন্য সঠিক সহায়তা প্রদান করা। আমরা সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে প্রান্তিক খামারিরা তাদের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারে। সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘিত হলে, সকল ফিড এবং মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারীদের কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকারের উদ্যোগে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। ডিম-মুরগির বাজারসহ পোল্ট্রি শিল্পে স্থিতিশীলতা আসে। এমন পদক্ষেপ তো সরকারের তরফেই নিতে হবে। সরকার এ ব্যাপারে মনোযোগ গভীর করবে- এটাই প্রত্যাশা।