স্বাস্থ্য খাত
লেলিন চৌধুরী
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১১:২৯ এএম
লেলিন চৌধুরী
দেশে স্বাস্থ্য খাতের কার্যক্রম ও সেবা বলতে মূলত চিকিৎসাসেবাকেই বোঝানো হয়। অথচ চিকিৎসাসেবা স্বাস্থ্যসেবার একটি অংশমাত্র। স্বাস্থ্য খাতের কিছু স্তম্ভ থাকে যার একটি হচ্ছে যেসব রোগের সুস্থতা নিশ্চিত করা যায় না তাদের যন্ত্রণা উপশমকারী স্বাস্থ্যসেবা। দ্বিতীয়টি প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা এবং শেষটি চিকিৎসামূলক স্বাস্থ্যসেবা, যা পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা বলে পরিচিত। যেকোনো উন্নত দেশে এ কটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্যসেবা পরিচালিত হয়। দেশে পুনর্বাসনমূলক ও প্রতিরোধমূলক কিছু স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে। এমনিতে যন্ত্রণা উপশমমূলক স্বাস্থ্যসেবার সুষ্ঠু অবকাঠামো নেই। দেশে চিকিৎসাসেবার ৫৫ শতাংশ সরকারি হাসপাতাল এবং বাকি ৪৫ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতাল দিয়ে থাকে। দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান ও অবস্থা নিয়েই যত আলোচনা হয়। বেসরকারি ও উন্নত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান বলে দাবি করা হাসপাতাল নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না। বিশেষত বেসরকারি খাতে পর্যবেক্ষণ-তদারকি করা এবং এর বিকাশে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের গাফিলতি চরমে। আর এ অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সেবার মানোন্নয়নে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে আইনি কাঠামো অত্যন্ত জরুরি যা আমাদের একেবারেই নেই।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতালে যখন কোনো রোগী চিকিৎসা নিতে যান এবং তাকে চিকিৎসাপত্র দেওয়া হয় তখন সেখানকার অন্তত ৭৩ শতাংশ (কোনো কোনো জরিপে ৮০-৮৩ শতাংশ) ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে, রোগী যেন পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা পায় এবং তাদের প্রেসক্রিপশনে দেওয়া ওষুধের সরবরাহ সরকারি হাসপাতালে থাকে। কারণ সরকারি হাসপাতালে যারা সেবা নিতে যান তাদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে এসব ওষুধ কেনা একেবারেই সম্ভব হয় না। আবার রোগীর বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা দেওয়া হয়। অনেক সরকারি হাসপাতালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়ায়, যন্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী ব্যক্তি না থাকা এবং অন্যান্য কারণে এসব সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। রোগীদের বাধ্য হয়ে তখন বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে যেতে হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলেও ভুল আসে এবং বাড়তি অর্থ খোয়াতে হয় রোগীদের। এসব সমস্যা মূলত তদারকির অভাবের কারণেই এত বাড়তে পেরেছে। সাধারণ মানুষের অনেকেই এসব জটিল বিষয় বোঝে না বিধায় তারা ভোগান্তির শিকার হয়। তাই অনেকে প্রত্যাশা করেন, এসব পরীক্ষানিরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে সম্পন্ন করতে পারলেই তাদের জন্য সবচেয়ে সুবিধার হয়ে থাকে। এ বিষয়টিও স্বাস্থ্য খাতে নিশ্চিত করা জরুরি।
ভুলে গেলে চলবে না, সরকারি হাসপাতাল মূলত নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়ার একটি বড় মাধ্যম। অর্থাৎ যারা এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের বড় অংশ স্বল্প আয়ের এবং নিরক্ষর। অথচ এদের লাইনে দাঁড়াতে হয় এবং হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার জন্য অনেক সময় নানা প্রান্তে ছোটাছুটি করতে হয়। আবার লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার সময় হাসপাতাল কর্মীরা তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করে-এমন অভিযোগও কম নয়। একজন রোগীর মর্যাদা এভাবে ব্যাহত হয় যা মোটেই সেবা খাতের কাছে প্রত্যাশিত নয়। সাধারণ মানুষও এ ক্ষেত্রে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। সরকারি হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয় সত্য। কিন্তু মানুষকে বুঝতে হবে, তাদের প্রদেয় অর্থ দিয়েই তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ভাবনাটি যখন তাদের মধ্যে গড়ে উঠবে তখন যারা এ খাতে সেবা প্রদান করে তারা কোনো ধরনের বাজে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না। দেশে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে। নগরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। এ দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের। যেহেতু দেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোর অবস্থা একেবারে নাজুক তাই শহরবাসীর প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার অবস্থা খুবই জীর্ণদশায় রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে যুক্ত করা জরুরি। এলাকাভিত্তিক, জেলাভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক এবং বিশেষায়িত স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান গড়ার বিষয়েও ভাবতে হবে। বিগত সরকারের আমলে গ্রামবাসীদের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়। শহরাঞ্চলে এরই আদলে এমন স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ নিজ পকেট থেকে চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। জরিপে পাওয়া এ জনসংখ্যাকে আমাদের একবার হলেও চিহ্নিত করে তাদের সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া উচিত। দারিদ্র্য দূর করার জন্যই সরকারি হাসপাতাল গড়ে তোলা। আবার এ সরকারি হাসপাতালের নানা সমস্যার কারণে মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে, এমন উল্টোচিত্র দেখা যাচ্ছে। এ সমস্যা এক অন্তহীন চক্রে রূপান্তরিত হচ্ছে যেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা জরুরি। চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষ যেন দারিদ্র্য, দুর্ভোগের শিকার না হয় তা নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাজ করতে হবে। দেশের স্বাস্থ্য খাতের নানা সংকট পর্যবেক্ষণ করে অনেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত, থাইল্যান্ডের মতো দেশে চলে যায়। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৫ লাখের মতো রোগী ভারত যায়। স্বাস্থ্যসেবা নিতে তাদের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে নানা সংকটের কারণে অনেকে সেখানের মেডিকেল ভিসা পাচ্ছে না। থাইল্যান্ডে সরেজমিনে দেখা যায়, চিকিৎসা, পর্যটনসহ বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশিদের কাছে ভারতের বিকল্প বাজার হয়ে উঠছে থাইল্যান্ড। চিকিৎসার জন্য বড় অংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি বেছে নিচ্ছে। ইদানীং থাইল্যান্ডগামী ফ্লাইটেও বেড়েছে যাত্রীর চাপ। থাইল্যান্ডে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা জানান, সহজ ভিসা, স্বল্প সময় ও কম বিমান ভাড়া, উন্নত চিকিৎসা, সুলভ মূল্যে থাকাখাওয়া, আকর্ষণীয় পর্যটন, প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমসহ নানা সুবিধা বিবেচনায় তারা থাইল্যান্ডে ঝুঁকছেন।
ভারতের প্রতি আমাদের দেশের রোগীদের আস্থার একটি বড় কারণ সেখানকার চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলোর অনেক প্রতিনিধি এখানে অফিস করেন। তারা কনসালট্যান্সির মাধ্যমে ভারতে রোগীদের যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করেন। অনেক ডাক্তার মাসে কিংবা সপ্তাহে একবার বাংলাদেশে এসে রোগীও দেখেন। একটি চক্র কমিশনের বিনিময়ে বাংলাদেশিদের ভারতে যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। এ চক্রটি বেশ শক্তিশালী এবং নানা কারণে এদের এখনও শনাক্ত করার বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ চক্রটিকে বন্ধ করার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। পাশাপাশি শুধু চিকিৎসাসেবা নয়, স্বাস্থ্য খাতে টেকসই উন্নয়নসাধন জরুরি। এ খাতের সংশ্লিষ্ট সবাই নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। তার পরও কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুসরণে তাদের আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যা অবশ্যই বাস্তবিক সমস্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তা ছাড়া হাসপাতালে সেবাগ্রহীতা ভুল চিকিৎসা পেলে কোথাও অভিযোগ করবেন এমন নির্দিষ্ট এবং ভোগান্তিহীন জায়গা এখনও গড়ে তোলা যায়নি। ফলে ভুল চিকিৎসার কারণেও অনেকের প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টির দিকে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া দরকার এবং অভিযোগ সেল গঠন করার মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। প্রতিটি অভিযোগের তদন্তের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রোগীর স্বার্থে তদন্ত কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করে তাদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাত অন্য খাত থেকে ভিন্ন বিধায় এ খাতের সমস্যার সমাধান দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারলেই ভালো।
এবার মুদ্রার উল্টোপিঠের দিকেও তাকানো জরুরি। দেশে অনেক সময় হাসপাতালে চিকিৎসক কিংবা সেবিকাদের রোগীর আত্মীয়স্বজন হেনস্থা, গালমন্দ এমনকি শারীরিক নির্যাতন করে। এমন ঘটনার ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা অভিযোগ সেলে উত্থাপন করতে হবে এবং নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তার সমাধান করতে হবে। কিন্তু সহিংসতার মাধ্যমে হাসপাতালের পরিবেশ তো বটেই, কর্মীদের আঘাত করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। দুঃখজনক হলেও অনেকাংশেই সত্য, অনেক অপ্রিয় ঘটনাই শেষ পর্যন্ত সবার জন্যই বড় ধরনের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা এমন এক ব্যবস্থার প্রত্যাশা করছি যেখানে চিকিৎসক ও সেবাপ্রত্যাশীদের অধিকার ভঙ্গ হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। বরং চিকিৎসা খাত নিয়ে যে অভিযোগ রয়েছে তা দূর হবে এবং একটি টেকসই সমাধানের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।