বাণিজ্য সহজীকরণ
কবির আহমেদ
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:৩১ পিএম
কবির আহমেদ
ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং খাত বিশ্ববাণিজ্যের মেরুদণ্ড সমতুল্য, যা সীমান্তজুড়ে পণ্যের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস, সামুদ্রিক খাবার, ওষুধ, কৃষিপণ্য, চামড়া, অপচনশীল আইটেম এবং আরও অনেক পণ্যের রপ্তানি সহজতর করার জন্য এ খাতটি গুরুত্বপূর্ণ। এর গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও দেশে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যা তাদের দক্ষতার সঙ্গে কাজ পরিচালনা করার ক্ষমতা বাধা দেয় এবং বাণিজ্য সহজীকরণে সর্বোত্তমভাবে অবদান রাখে।
ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারের ভূমিকার স্বীকৃতির অভাব : স্টেকহোল্ডাররাÑ যেমন উৎপাদক, রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারকরা প্রায়ই ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের ভূমিকা অবমূল্যায়ন করে। তাদের কৌশলগত অংশীদারের পরিবর্তে কেবল পরিষেবা প্রদানকারী হিসেবে গণ্য করে। এর ফলে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিশ্বাস ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে নীতি প্রণয়নে খুব কমই ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার বা অন্যান্য মূল স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়। এর ফলে এমন নীতি তৈরি হয় যা প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হয় এবং জটিলতা তৈরি করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, সরকারি সংস্থা, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা প্রায়ই সমস্যার সম্মুখীন হন। নিয়ন্ত্রক এবং সুবিধাদাতারা এখনও বাণিজ্য সহজীকরণে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের কৌশলগত গুরুত্ব পুরোপুরি স্বীকার করতে পারেনি।
লাইসেন্সিং এবং নিয়ন্ত্রক সমস্যা : এনবিআর দ্বারা নির্ধারিত লাইসেন্সের প্রবিধানগুলো পুরোনো এবং এর জরুরি সংশোধন প্রয়োজন। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের প্রতিটি বন্দরের জন্য আলাদা লাইসেন্স পেতে হয়, যা শুধু অপারেশনাল জটিলতা বাড়ায়। সারা বাংলাদেশে একটি ইউনিফায়েড লাইসেন্সের ব্যবস্থা থাকলে তা এ কার্যক্রম সুগম করবে।
কাস্টমস কার্যক্রমে অদক্ষতা : কাস্টমস কার্যক্রমের অদক্ষতার কারণে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের প্রায়ই অযথা বিলম্বের সম্মুখীন হয়। দীর্ঘ লাইন এবং প্রতিদিনের আনুষ্ঠানিকতার ধীরপ্রক্রিয়া এ বিলম্বের প্রধান কারণ। ইমপোর্ট জেনারেল ম্যানিফেস্ট (আইজিএম) এবং এক্সপোর্ট জেনারেল ম্যানিফেস্ট (ইজিএম) ঘিরে স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত এবং জটিল প্রক্রিয়াগুলো ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের দক্ষতা এবং প্রতিযোগিতা আরও কমিয়ে দেয়। কাস্টমসের সিদ্ধান্তের ফলে প্রায়ই বিলম্ব, জরিমানা এবং অপ্রয়োজনীয় জটিলতা দেখা দেয়। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা প্রায় সময় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যথাযথ কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছাতে ঝামেলায় পড়ে। সময়মতো যোগাযোগের অভাবও এ বিলম্ব বৃদ্ধি করে আর অনিশ্চয়তা বাড়ায়। বিদ্যমান প্রবিধানের অস্পষ্টতাগুলো অন্যায় পথে প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করে। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা প্রায়ই সঠিক নিয়মের পরিবর্তে কর্মকর্তাদের দ্বারা সাবজেকটিভ জাজমেন্টের শিকার হয়, যার ফলে কার্গো ক্লিয়ারেন্সে বিলম্ব হয় এবং খরচ বৃদ্ধি পায়, যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।
মাত্রাতিরিক্ত কর এবং ব্যাংকিং নীতি : বাংলাদেশের ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে উচ্চ করের সম্মুখীন হয়, যেমন শিপিং লাইন এবং বিদেশি অ্যাজেন্টদের পেমেন্ট। এর সঙ্গে রয়েছে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং অগ্রিম আয়কর (এআইটি), যা খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে। ফরমাল ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ওপরও উচ্চ কর আরোপ করা হয়, যা আর্থিক বোঝা আরও বৃদ্ধি করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগুলো এ অপারেশন আরও জটিল করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, বিল অব লেডিং (বিএল) (আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে প্রয়োজনীয় নথি) বাংলাদেশ ব্যাংকের বাধ্যতামূলক মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ম্যানুয়াল যাচাইকরণ প্রক্রিয়ার কারণে অকার্যকর রয়ে গেছে। এ বিলম্ব সাপ্লাই চেইন ব্যাহত করে এবং অপারেশনাল খরচ বাড়ায়। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো বিদেশি পরিষেবা প্রদানকারীদের অর্থ প্রদান। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা দীর্ঘ অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং অত্যধিক ডকুমেন্টের প্রয়োজনীয়তার সম্মুখীন হয়, যা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ককে চাপ দেয়। পেমেন্ট ট্রান্সফারে বিলম্বের ফলে জরিমানাও হয় এবং পারস্পরিক সুসম্পর্কের সুযোগ নষ্ট হয়।
শিপিং লাইন দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত অনুশীলন : বাংলাদেশে শিপিং লাইনগুলো প্রায়ই পূর্ব নোটিস বা যুক্তি ছাড়া নির্বিচারে চার্জ আরোপ করে। বিলম্বিত কনটেইনার রিটার্নের জন্য আটক চার্জ যা প্রায়ই বন্দর যানজট বা কাস্টমসের অদক্ষতার কারণে হয়, তা ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের দ্বারা বহন করা অন্যায্য খরচের একটি প্রধান উদাহরণ। অতিরিক্ত চার্জ যেমন নন-শিডিউল ফি এবং অপ্রত্যাশিত বিলম্ব জরিমানা, এ বোঝা আরও বাড়ায়। কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি শিপিং লাইনের মধ্যে একচেটিয়া আচরণের সুযোগ দিয়েছে, যেখানে প্রভাবশালীরা ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার এবং তাদের ক্লায়েন্টদের জন্য শর্তাদি নির্দেশ করে। এ অব্যবস্থাপনা খরচ বাড়ায়, একটি অনৈতিক বাণিজ্য পরিবেশ তৈরি করে এবং দেশের বাণিজ্য খাতের প্রতিযোগিতা হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
বন্ডেড ওয়্যারহাউসিং এবং কার্গো ভিলেজে চ্যালেঞ্জ : বন্ডেড ওয়্যারহাউস বাণিজ্য সুবিধার জন্য অত্যাবশ্যক, কিন্তু অদক্ষতা এবং পুরোনো প্রবিধানগুলো তাদের কার্যকারিতাকে বাধা দেয়। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা কিছু সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে, যার মধ্যে বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সগুলো ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং লাইসেন্সের সঙ্গে একত্র করা, যা অপারেশনের পথ সুগম করবে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা নির্বিচারে চার্জ, অপর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা এবং কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটরের (কেপিআই) জন্য সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিমানবন্দরে সিঙ্গেল এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস) বাধা সৃষ্টি করে; যার ফলে পণ্যগুলো স্ক্রিনিংয়ে বিলম্ব হয়। অপ্রতুল জায়গার কারণে যানজট হয় এবং পণ্যের অব্যবস্থাপনা হয়; সঙ্গে অপর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা চুরির বিষয়ে উদ্বেগ বাড়ায়।
বন্দর জটিলতা : চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির প্রধান প্রবেশদ্বার। কিন্তু বন্দরটি অব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অপর্যাপ্ত বার্থ, ক্রেন এবং কনটেইনার স্টোরেজ অসুবিধার কারণে সৃষ্ট যানজটের জন্য উল্লেখযোগ্য বিলম্ব হয়, বিশেষ করে দ্রুত রপ্তানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে। ডেলিভারি না হওয়া কনটেইনারগুলো এ সমস্যা আরও জটিল করে তোলে। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা দাবিহীন চালানের ব্যাকলগ রিপোর্ট করে, যার ফলে শিপিং লাইন দ্বারা উচ্চ জরিমানা এবং কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এটি স্থানীয় অপারেশন এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন ব্যাহত করে। ১৯৬৯ সালের শুল্ক আইনের ধারা ৮২ কার্যকরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে এ সংকটের জন্য দায়ী করা হয়। এ ধারায় অদাবিকৃত পণ্যের সময়মতো নিলাম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য অবিলম্বে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। স্ট্রিমলাইনিং লাইসেন্সিং : সারা বাংলাদেশে একটি ইউনিফায়েড লাইসেন্সিং সিস্টেম বাস্তবায়ন এবং আবেদন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করা। বিলম্ব কমাতে এবং দক্ষতা উন্নত করতে কাস্টমস অপারেশন সহজীকরণ এবং ডিজিটালাইজ করা।
নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি : শিপিং লাইনের মাধ্যমে একচেটিয়া চর্চা প্রতিরোধ করার জন্য মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা স্থাপন করা। বন্ডেড ওয়্যারহাউস এবং বন্দর সুবিধা সম্প্রসারণ করা, স্থানের সীমাবদ্ধতা দূর করা এবং উন্নত স্ক্রিনিং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা। বিল অব লেডিং এবং বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন সহজভাবে পরিচালনার সুবিধার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবিধান আপডেট করা।
স্টেকহোল্ডার এনগেজমেন্ট : প্রতিটি ধাপে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সেগুলোর সমাধান নিশ্চিত করতে নীতি প্রণয়নে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার এবং অন্য স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করা উচিত। বাংলাদেশে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং সেক্টর তার বাণিজ্যচালিত অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য; কিন্তু অনেক পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কাস্টমসের অদক্ষতা, শিপিং লাইনের একচেটিয়া চর্চা, পুরোনো বিধিবিধান এবং অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো এ খাতের সম্ভাবনা আটকে রেখেছে। বাণিজ্যিক পরিবেশের উন্নতির জন্য নীতির আধুনিকীকরণ, নিয়ন্ত্রকদের ওপর তদারকি বাড়ানো এবং অবকাঠামোয় বিনিয়োগসহ জরুরি সংস্কার অপরিহার্য। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার, নিয়ন্ত্রক এবং বেসরকারি স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং সেক্টরের পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচন করতে পারে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে তার প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে পারে। এ উদ্যোগগুলো নেওয়া এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে অবিলম্বে একটি সংস্কার কমিশন গঠন করা জরুরি মনে করি।