× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

যে শূণ্যতা কোনোদিন পূরণ হবে না

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:৩৬ পিএম

আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:৩৭ পিএম

যে শূণ্যতা কোনোদিন পূরণ হবে না

জাতীয় কবি কাজী নজরুল বলেছেন, ‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শীর। ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।’ বাঙালি বীরের জাতি। জাতির চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয়-নির্ভীক-স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। প্রতিটি লেখনী-কবিতা-নাটক-গান-চিত্রকর্ম ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মযজ্ঞে প্রতিফলিত হয়েছিল স্বাধীনতার সচেতন বার্তা। রাজনীতির সমান্তরাল সাংস্কৃতিক জাগরণে জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল সকল স্তরের বুদ্ধিজীবীরা। ধারাবাহিকতায় দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় রচিত হওয়ার ক্ষণ ১৪ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ের স্বাদ গ্রহণের ঠিক আগ মুহূর্তে পরাজয়ের গ্লানিমাখা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররা পরিকল্পিতভাবে দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। চরম প্রতিহিংসাপরায়ণতার বশবর্তী হয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাদের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য শিক্ষাবিদ-সাংবাদিক-চিকিৎসক-আইনজীবী-প্রকৌশলী-কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীসহ নানা পেশার প্রথিতযশা ব্যক্তিদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। লালসবুজ পতাকার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্নে জাতিকে পরিপূর্ণ মেধাশূন্য করতে এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই শূণ্যতা কোনো পূরণ হওয়ার নয়। 

বাঙালি জাতি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু-দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পৃথিবীতে যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সে লক্ষ্যেই এ নীলনকশা বাস্তবায়নে ঘৃণ্য উন্মাদনায় দেশব্যাপী এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিল। পরবর্তীতে ঢাকার রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণকবরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষত-বিক্ষত বিকৃত মরদেহ পাওয়া যায়। অনেকের দেহে ছিল বহু গুলি-আঘাতের চিহ্ন, অনেকের চোখ-হাত-পা বাঁধা এবং বেয়নেট খুচিয়ে পৈশাচিক হত্যার নিদর্শন। হত্যার পূর্বে তাদের নির্যাতনের এমন বীভৎস চিত্র বিশ্বে বিরল। খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা অনেক লাশ শনাক্ত করা যায়নি। অনেকের লাশের কোনো সন্ধান মেলেনি। হয়তো শকুন কিংবা কুকুর খেয়ে ফেলেছে, না হয় এমন কোনো গর্তে বা স্থানে ফেলে দিয়েছে, যা আর কেউ কখনও খুঁজে পায়নি। এমন নৃশংসতার নজির ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ বিষয়। 

ঘাতকদের হাতে সেদিন শহীদ হওয়া সূর্যসন্তানদের মধ্যে রয়েছেনÑ অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, আধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. মুর্তজা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান, এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ আরও অনেকে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সাময়িকী নিউজ উইক-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন রচিত নিবন্ধ সূত্রমতে, নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ সূত্রে ২৩২ জন বুদ্ধিজীবী হত্যার তথ্য জানা গেলেও তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথাও স্বীকার করা হয়েছে। 

গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এটি সুস্পষ্ট যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন এই কৃতী বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছিল হানাদার বাহিনীর মদদদাতাদের। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্যতম অপকর্মটি সম্পাদনে লিপ্ত হয় এই ঘাতক চক্র। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কালে খ্যাতিমান লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে প্রধান করে গঠিত ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। তার লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা।’ অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আপন ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের মৃতদেহ মিরপুরের বধ্যভূমিতে খুঁজতে গিয়ে তিনি নিজেও ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হন। 

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর রাজনৈতিক দর্শন ছিল কোনো জাতিকে অনুগত ও পদানত রাখতে হলে তাদের স্বাধীনচেতা-মুক্তমনা-আদর্শনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের আগে হত্যা করা। হিটলারের জার্মানিতে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা, জেলে দেওয়াসহ অনেকের বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিক রোম্যাঁ রোলাঁ হিটলারের কারাগারে বসেই লিখেছিলেন ‘আমি ক্ষান্ত হব না’। ইতালিতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির রাজত্বের সময় অসংখ্য শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আলবার্তো মোরাভিয়া দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে দশ বছর পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্মরণযোগ্য বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানে আইয়ুব খানের শাসনামলে তার পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত রাইটার্স গিল্ডের সভায় আলবার্তো মোরাভিয়াকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে লিখেছিলেন, ‘আমি দ্বিতীয় মুসোলিনির দেশে আসতে চাই না।’ 

সচেতন মহলসহ দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের সমন্বিত ফসল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত এই মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ছিল বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের বিশাল ও বিস্তৃত এক শোষণ-বঞ্চনার ঐতিহাসিক ধারা। রাজনৈতিক-সামাজিক জাগরণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয় বাঙালি জাতি। সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া বিভিন্ন আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে আবদ্ধ হয়ে ২৫ মার্চ কালরাতে ইপিআর, পুলিশসহ সকল স্তরের নিরস্ত্র জনগণের ওপর ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা পরিচালনা করে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ অতিক্রান্তে ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন পাক হানাদার বাহিনী বাংলা দামাল ছেলেদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবীরা মেধা-অভিজ্ঞতা-শ্রমের সমন্বয়ে তাদের সাধ্য অনুযায়ী নানাভাবে সাহায্য করেন তাদের কাছে আমাদের অশেষ ঋণ। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে দেশের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীদের অপরিসীম অবদান অবিস্মরণীয়। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাও ছিল অতুলনীয়। তারাও নিজস্ব অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। বৈদ্যনাথতলায় দেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন, মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরে প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ, বাংলাদেশের প্রথম সরকারের নানাবিধ প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বহুসংখ্যক ব্যক্তিদের দায়িত্ব প্রদান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে বুদ্ধিজীবীদের সাহসিক কর্মকাণ্ড চিরস্মরণীয়। 

আমাদের এখন কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ায় সবাইকে ভূমিকা পালন করতে হবে। জুলাই-আগস্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র সংস্কারসহ জন-অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজের বিভিন্ন সচেতন মহল ও সরকারের তরফে প্রায় সমস্বরে উচ্চারিত হয়েছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। আমরা এই শক্তি ধারণ করে নিশ্চয়ই একদিন পৌঁছে যাব কাঙ্ক্ষিত স্তরে। আমরা জানি, রাজনীতিকরা যদি শুদ্ধাচারীর রাজনৈতিক ব্যবস্থার পথ সুগম করতে পারেন তাহলে ইতিবাচক অনেক কিছুই দৃশ্যমান হবে। যেকোনো সমাজ কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং রাজনীতিকরা এর নিয়ামক শক্তি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, যে পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হলো এর মর্মার্থ রাষ্ট্রের সব স্তরের মানুষ তো বটেই বিশেষ করে রাজনীতিকরা তা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। 

স্বাধীনতা অর্জনের পর পাঁচ দশকেরও অনেক বেশি সময়ে আমরা অতিক্রম করে এলেও এখনও আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে পারিনি এবং কেন তা সম্ভব হয়নি এই ব্যর্থতার দায় কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৪ ডিসেম্বর দিনটিকে বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবী স্মরণে মিরপুরে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। ১৯৯১ সালে ঢাকার রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নামে আরেকটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। আজকের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সকল স্তরের জনগণ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবীসহ সম্ভ্রমহারা ২ লক্ষ জননী-জায়া-কন্যার সর্বোচ্চ অবদানকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। একই সঙ্গে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি জুলাই-আগস্ট ২০২৪ গণহত্যায় শহীদ শিক্ষার্থীসহ আপামর জনগণের স্মৃতির প্রতি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ ও অপরাধবিজ্ঞানী

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা