সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৯ এএম
সাধারণত বর্ষা মৌসুমেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হলেও এবার বর্ষার পরও টানা কয়েক মাস ধরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পরিলক্ষিত হচ্ছে। ৩০ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার শীতেও ভোগাবে ডেঙ্গু। এর পার্শ্ব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার অনেক হাসপাতাল। ঢাকার বাইরেও এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। ওই প্রতিবেদনেই আরও বলা হয়েছে, নভেম্বরের ২৯ দিন ডেঙ্গুর রেকর্ড ১৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ষড়ঋতুর এ দেশে এখন বছরব্যাপী ডেঙ্গু আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বলেছেন, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ নাগাদ হয়তো ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমে আসতে পারে। তারা ডেঙ্গুর ভয়াবহতার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি সরকারের দায়সারা পদক্ষেপ, এডিস মশার প্রজনন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ায় ঘাটতি, পর্যাপ্ত গবেষণা না করা ও জনসচেতনতার অভাবই এত মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এ বছর ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ৯০ হাজার ছাড়িয়েছে
এবং ঢাকাতেই সংখ্যা বেশি। স্বাধীনতা-উত্তর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু ঘটে
গত বছর। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীর মৃত্যুহার বেশি।
আক্রান্তের দিক থেকে এগিয়ে আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত
যে তথ্য উপস্থাপন করে এই পরিসংখ্যান সবক্ষেত্রে সঠিক নয়Ñ এমন অভিযোগও আছে। এই সম্পাদকীয়
স্তম্ভেই আমরা নিকট অতীতেও বলেছি, ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। একই
সঙ্গে আমরা এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিশেষ
কর্মসূচি নেওয়ার কথাও বলেছিলাম। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা
ও পূর্বপ্রস্তুতির অভাবকেই স্পষ্ট করে তুলছে।
কীটতত্ত্ববিদরা ইতোমধ্যে কয়েকবার ঢাকা মহানগরীর মশার ঘনত্ব বৃদ্ধির
প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। পাশাপাশি তারা বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু সুপারিশও
তুলে ধরেন। কিন্তু এডিস মশা নির্মূলে কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় ডেঙ্গু
পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। অভিযোগ আছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ
এখনও গতানুগতিক এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়েরও
যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আমরা মনে করি, এডিস মশার প্রজনন রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
বিধায়ই সংকট আরও বেড়েছে। এর পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু শনাক্তকরণে ঘাটতি এবং
চিকিৎসার বিলম্ব উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা দেখছি, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে
এ বছরও যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সমন্বয়হীন ব্যবস্থাপনা ও যথাসময়ে পদক্ষেপ
নেওয়ার ঘাটতির যে বিষয়গুলো সামনে এসেছে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সব পক্ষকে খতিয়ে দেখে
দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে আমরা মনে করি।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে, ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলার আর কোনোই
অবকাশ নেই। ডেঙ্গু প্রতিরোধযোগ্য রোগ হলেও দুঃখজনক হচ্ছে, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে
এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বাড়ছে। এমনটি মেনে নেওয়া যায় না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার
অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানো ও স্থানীয় সরকার এবং সিটি করপোরেশনের
সমন্বয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করার বিষয়ে নানা মহল থেকে
বলা হলেও কেন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর ঢিলেঢালা ভাব পরিলক্ষিত
হচ্ছে, এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমরা জানি, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শাসনামলে দফায় দফায় মশক
নিধনের ওষুধ পাল্টানো হয়েছে এবং নকল ও ভেজাল ওষুধ আমদানি করা হয়। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত
প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের
দায়সারা ভাব কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা মনে করি, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের
পাশাপাশি এর বংশবৃদ্ধির রাশ টেনে ধরা কঠিন হতো না যদি সমন্বিত পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া
হতো।
আমরা এও মনে করি, দ্রুত দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর
সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। একই সঙ্গে ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার কাঠামোর
বিভিন্ন স্তরের সহযোগিতায় জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ
রূপ নিতে পারে এবং ডেকে আনতে পারে বিপর্যয়। ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা পেতে বছরব্যাপী মশক
নিধন ও অন্যান্য কার্যক্রম জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। ডেঙ্গুর উৎস পুরোপুরি নির্মূল
করতেই হবে। নাগরিক সমাজকেও সচেতন হতে হবে এবং দায়িত্ব নিয়ে প্রতিটি পরিবার ও প্রতিষ্ঠানে
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। সম্মিলিত প্রয়াসে ডেঙ্গু
মোকাবিলায় নিতে হবে যথাযথ ব্যবস্থা।