বিজয়ের মাস
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৮ এএম
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ওই দিনগুলোয় বেঁচে থাকাটা সহজ ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কর্মচারীরা আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছিলেন তারা কোথায় গিয়ে থাকবেন, কেমন করে যাবেন কিছুই জানতেন না। প্রায় সব ক্ষেত্রেই পরিবারের যিনি প্রধান তিনিই প্রথমে নিহত হয়েছেন। এমনিতেই তাদের আয়-উপার্জন ছিল সীমিত; তার মধ্যে অপ্রত্যাশিত ও অবিশ্বাস্য ওই সব মৃত্যু। শোকে দুঃখে বেদনায় প্রতিটি পরিবার ছিল অভিভূত। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। দুঃসহ ওই যন্ত্রণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আশ্রয়হীনতা এবং টাকাকড়ির অভাব। খাবারদাবার নেই। জামাকাপড়ের পর্যন্ত অভাব। এমন ঘটেছে যে, গায়ের যে জামা বা শাড়িটি পরে বেরিয়েছেন নয় মাস ধরে সেটিই পরে থাকতে হয়েছে। ওদিকে আবার দেশে তখন শুরু হয়ে গেছে নীরব দুর্ভিক্ষ। চারদিকে অভাব। সর্বোপরি রয়েছে হানাদারদের আক্রমণের শঙ্কা।
সে এক সময়, বাংলাদেশজুড়ে
যখন চলছিল মানুষের মনুষ্যত্বের অসম্ভব কঠিন এক পরীক্ষা। সহ্যের পরীক্ষা, পরীক্ষা দয়ামায়ারও।
ওই বিপদে মানুষ মানুষকে সাহায্য করেছে, যে যে ভাবে পারে। সামর্থ্যের প্রাচুর্য ছিল
না, অভাব-অনটন, নিরাপত্তাহীনতা ছিল সর্ববিস্তারী। ওই পরীক্ষায় অধিকাংশ মানুষই উত্তীর্ণ
হয়েছে। হানাদাররা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের আলাদা করতে চাইত। অমুসলিমদের হত্যা করাটাও
তাদের বিশেষ রকমের নেশায় পরিণত হয়েছিল। জগন্নাথ হল এলাকায় বসবাসকারীদের ওপর যে হত্যাকাণ্ড
ঘটানো হয়, তার অতিরিক্ত কারণ এটি যে সেখানে বসবাসকারী কর্মচারীর অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু
সম্প্রদায়ের সদস্য।
বাস্তবতা হলো
এবং স্মরণযোগ্য হানাদারদের ওই আক্রমণে বাংলাদেশ থেকে তখন সাম্প্রদায়িকতা প্রায় অনুপস্থিত
করে দিয়েছিল। বিপন্ন মানুষ সাম্প্রদায়িক পরিচয় ভুলে গিয়ে পরস্পরের আত্মীয় হয়ে উঠেছিল।
মসজিদের ইমাম নিজেকে বিপন্ন হিন্দু পরিবারকে বাঁচিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের
কয়েকটি পরিবার আশ্রয়ের খোঁজে যখন দিশাহারা তখন হোসেনি দালানে শিয়াদের ইমামবাড়ায় প্রাথমিকভাবে
আশ্রয় পেয়েছিলেন, সেখানকার ধর্মপ্রাণ মানুষ আশ্রয়প্রার্থীরা যে হিন্দু সম্প্রদায়ের
সদস্য তা জানতেন, কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য তাদের বিবেচনায় আসেনি। সেই সম্প্রীতি
স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রমেই হারাতে থাকলো। তবে ক্ষেত্রবিশেষ মনুষ্যত্বের পরাজয় যে ঘটেনি
তা-ও নয়। রাজাকাররা ছিল। লুণ্ঠনকারীদেরও দেখা গেছে। যুদ্ধের সময়ই রোকেয়া হল ও জগন্নাথ
হলে ডাকাতি ঘটে।
গবেষকরা গবেষণার
মাধ্যমে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন তার অনেকাংশ হয়তো হারিয়েই যেত যদি তারা উদ্ধার না
করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সে বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা ও
প্রকাশনা ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু কর্মচারীদের ওপর একটি নিবিষ্ট সামগ্রিক গবেষণা
ও প্রকাশনা এই প্রথম। এ গ্রন্থের যারা প্রাণ তারা প্রকাশিত বইপত্র, পত্রিকা, প্রবন্ধ,
এমনকি কথাসাহিত্যিকের রচনা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছেন। গ্রন্থের পরিশিষ্টে মুক্তিযুদ্ধে
শহীদ কর্মচারীদের একটি তালিকাই শুধু নয়, প্রত্যেকের পরিচয়ও তুলে ধরেছেন। আর সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তারা করেছেন সেটি হলো, ভুক্তভোগীদের লেখা সংগ্রহ ও সাক্ষাৎকার
গ্রহণ। ১২ জন ভুক্তভোগীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ গ্রন্থের পরিশিষ্টে দেওয়া হয়েছে।
ওই ভুক্তভোগীরা তাদের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন নিজের মতো করে; নিজস্ব কথনে ও ভঙ্গিতে।
সেই মৌলিকত্বও গবেষণাগ্রন্থটিতে রক্ষিত হয়েছে। যারা সাক্ষাৎকার দিতে পারতেন তাদের অনেকেই
আজ বেঁচে নেই; যে কথাগুলো আমরা সাক্ষাৎকার দেওয়া মানুষের নিজের মুখে শুনতে পেলাম সেগুলোও
হয়তো পাওয়া যেত না গবেষকরা উদ্যোগী না হলে। গ্রন্থের সম্পাদক আশফাক হোসেন, সহযোগী সম্পাদক
কাজী সামিও শীশ, তাদের গবেষণা সহযোগী এবং সম্পাদনা পর্ষদের কাছে আমরা ঋণী হয়ে রইলাম
সময়োপযোগী পদক্ষেপটি নেওয়ার জন্য।
এ গ্রন্থটি আমাদের
সমষ্টিগত ইতিহাসের অংশ। সমষ্টির পক্ষে ইতিহাস ভুলে যাওয়া এবং ব্যক্তির পক্ষে স্মৃতিভ্রষ্ট
হওয়া একই রকমের দুর্ঘটনা। তবে ইতিহাস তো শুধু ঘটনার ধারাবিবরণী নয়; ইতিহাসে ঘটনার পর্যালোচনা
থাকে, থাকতে হয় কার্যকারণ-সম্পর্কের বিশ্লেষণ, আবশ্যক হয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের খবরও।একাত্তরে
যা ঘটেছিল তা হলো পাকিস্তান নামক অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটির ভেতরে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের
সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনিবার্য দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ। রাষ্ট্রটি ভাঙতই;
কীভাবে ভাঙবে, কতদিন পরে ভাঙবে সেটাই ছিল প্রশ্ন। ভাঙন ত্বরান্বিত করেছে রাষ্ট্রের
শাসকরাই, গণহত্যার মধ্য দিয়ে। তা রাষ্ট্র তো ভাঙলই, কিন্তু প্রশ্ন রইল তাতে পূর্ববঙ্গের
সংগ্রামী মানুষের মুক্তি এলো কি? যে মানুষের এমন কঠিন সংগ্রাম, দুর্ভোগ, আত্মত্যাগের
কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তার অভ্যন্তরে দেশের মানুষের স্বপ্ন ছিল যে মুক্তির,
যার জন্য যুদ্ধটাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি, মুক্তির সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটেছে কি?
এক কথায় তার জবাব হলো, না, ঘটেনি। যুদ্ধে প্রধান শক্তি ছিল জনগণ, জনযুদ্ধ ছিল মূলত
মেহনতিদের জনযুদ্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা ছিলেন ওই মেহনতিদেরই অংশ। নেতৃত্বে
ছিলেন উঠতি বুর্জোয়ারা। তাদের কেউ কেউ যুদ্ধে গেছেন, কিন্তু বড় অংশই হয় ছিল নিষ্ক্রিয়,
নয়তো শরণার্থী। যুদ্ধ শেষে উঠতি বুর্জোয়ারাই কিন্তু রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা পেয়ে গেছেন।
ক্ষমতা পেয়ে তারা নিজেদের উন্নতি ঘটিয়েছেন এবং পাকিস্তানি শাসকরা যা করেছিলেন তা-ই
করেছেন।
শোষণ ও লুণ্ঠনের
মাধ্যমে ধনী হয়েছেন; এবং ওই ধনের বেশ কিছুটা পাচার করে দিয়েছেন বিদেশে। পাচারের ব্যাপারে
আগের শাসকদের চাইতে তাদের আচরণ ভিন্ন ছিল না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে মেহনতিদের
শ্রমেই, তারা শ্রম দিয়েছেন দেশের ভেতরে এবং বিদেশে গিয়ে। কিন্তু উন্নয়নের ফল থেকে তারা
বঞ্চিত হয়েছেন। আগের শাসকদের শাসনকালে যেমনটা ঘটত; স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকের কর্মকাণ্ডেও
ঠিক তেমনটাই ঘটেছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে ধনীদের একটি উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছে। আগের কালে
সম্পদ চলে যেত দিল্লিতে, লন্ডনে এবং পিন্ডিতে; এখন যায় বিভিন্ন দেশে। সাধারণ মানুষের
বঞ্চনা ও দৈন্য ঘোচে না। সামগ্রিক বিচারে দেশ দরিদ্রই রয়ে যায়। এই হচ্ছে স্বাধীনতা-পরবর্তী
বাংলাদেশের ইতিহাস। এ ইতিহাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী কর্মচারীদের জীবনেও সত্য
বইকি।
ইতিহাসের ক্ষেত্রে
আরও একটি জিজ্ঞাসা থাকে। সেটি এ গবেষণাগ্রন্থটি পাঠকালেও উঠে আসে। জিজ্ঞাসাটা হলো ওই
যে পাকিস্তান-হিন্দুস্থানে যে ভাগাভাগি, যার ফলে দুর্ভোগের এতসব ঘটনা, সেটার জন্য
দায়ী কারা? জবাবটা আমাদের জানা আছে : দায়ী একদিকে ব্রিটিশ শাসকরা, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী
দুই রাজনৈতিক দলÑ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। ব্রিটিশের প্ররোচনা
ও আগ্রহ ছিল দেশভাগে। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের ছিল প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা। ওই দুই জাতীয়তাবাদী
দলের কোনোটাই এ সত্য মেনে নেয়নি যে ভারতবর্ষ একটি বা দুটি নয়, বহুজাতির একটি উপমহাদেশ।
কংগ্রেস বলেছে জাতি এখানে একটাইÑ সেটি ভারতীয়; মুসলিম লীগে দাবি জাতি রয়েছে দুটিÑ হিন্দু
ও মুসলমান। তাই মুসলমানের জন্য স্বতন্ত্র একটি বাসভূমি চাই। এ দ্বন্দ্বে সাতচল্লিশের
দেশভাগ ঘটে, যেটি ছিল আমাদের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধের পর দ্বিতীয় ট্র্যাজেডি; এবং ওই
ট্র্যাজেডির ধারাবাহিকতাতেই একাত্তরের যুদ্ধটি ঘটেছে।
ইতিহাস পাঠকালে
জিজ্ঞাসা থাকে এও যে, স্বাধীন হয়েও আমরা যে মুক্ত হতে পারলাম না, সে সমস্যার সমাধান
কী? অর্থাৎ মুক্তি আসবে কোন পথে? কোন পথে এগোলে সাধারণ মানুষের দুঃখ ঘুচবে। জবাবটাও
পাওয়া যাবে আমাদের ইতিহাসের মধ্যেই। সেটি হলো এই যে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন
বেশ কয়েকবার ঘটেছে। কিন্তু যেটা ঘটেনি সেটা হলো, সামাজিক বিপ্লব। রাষ্ট্র বদলেছে নামে ও আয়তনে;
শাসকবদলও দেখতে পেয়েছি, কিন্তু সমাজের ভেতরে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক তাতে
কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। সেই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, ১৭৯৩ সালের, যার মধ্য দিয়ে
মূল সামাজিক সম্পর্কটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল জমিদার ও প্রজার, সে সম্পর্কটাই নানান নামে
ও ভাবে পুনরুৎপাদিত হয়েছে। ওই ব্যবস্থাটা না ভাঙলে মুক্তি যে আসবে না তা ঐতিহাসিক ভাবে
ও কারণে সত্য।
পরিশেষে, ইতিহাসের চর্চা যে অত্যাবশ্যকীয় সে কথাটা পুনরায় স্মরণ করা যাক। ইতিহাস পাঠে আমরা নিজেদের পরিচয় জানি, বর্তমানকে বুঝতে পারি এবং ভবিষ্যতের জন্য পথনির্দেশ পাই। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার এই যে, ইতিহাসের চর্চা এখন কমে গেছে। নিম্নগতির সেই ধারার বিপরীতে অন্য একটি ধারাও অবশ্য আছে; গবেষণাগ্রন্থটি ওই বিপরীত ধারারই একটি প্রতিনিধি। এর রচয়িতাদের পুনরায় অভিনন্দন। একইসঙ্গে প্রত্যাশা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলো আরও ব্যাপকভাবে চারদিকে ছড়াক।