একজন ইসরায়েলির জবানবন্দি
ড. ওফার কাসিফ
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৫ এএম
ড. ওফার কাসিফ
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই বিস্মিত হয়েছিল। সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিয়মের ব্যত্যয়ের কোনো সুযোগ নেই। যাদের স্বাধীন বিচার বিভাগ রয়েছে তারা কীভাবে আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মের বিঘ্ন ঘটাল? যারা গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্কের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে, তাদের কাছে অন্তত বিস্তারিত ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। গাজায় গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য এই দুই ব্যক্তি দায়ী। গাজার পশ্চিম তীরে নির্বিচারে বোমা হামলা এবং পশ্চিম তীরে অবৈধ দখলদারদের উন্মাদনার পাশাপাশি অবৈধভাবে পূর্ব জেরুজালেম খালি করে দেওয়ার ঘটনা বিবেচনা করলে বিষয়টি অবাক হওয়ার নয়। বিগত কয়েক যুগ ধরে ফিলিস্তিনিরা মানবিক অধিকার কিংবা স্বাধীনভাবে নিজ বাসভূমে বিচরণের অধিকার নেই। ইসরায়েলের দখলদারত্বের অধীনেই তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। যেকোনো ফিলিস্তিনির কাছে ইসরায়েলের দখলদারত্ব ঔপনিবেশিক শাসনের চেয়ে কম ভারী নয়। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশি।
অদ্ভুত হলেও সত্য, ইসরায়েল সরকার এই ফাঁপা নিয়মকে কোনোভাবে ফিলিস্তিনকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। ফিলিস্তিনকে নিয়ন্ত্রণ করার অজুহাতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ফিলিস্তিনি নারী ও শিশু হত্যা করে চলেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। প্রকৃতপক্ষে উত্তর গাজা এখন জনশূন্য। গাজার হাসপাতাল থেকে শুরু করে সব অবকাঠামোই আঘাতের লক্ষ্যবস্তু। ক্ষুধা ও অবরুদ্ধ করে রাখাকে যদি যুদ্ধাস্ত্র বলে বিবেচনা করা হয়, তাহলে নেতানিয়াহুর সরকার যুদ্ধাপরাধে জড়িত। মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের সব পথও তারা বন্ধ রেখেছে। বাস্তবে গণহত্যা বোঝানোর জন্য আর কত যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে? একই সময় পশ্চিম তীরে জাতিগত নিধন চলছে। ফিলিস্তিনে ২০টিরও অধিক জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করে ফেলা হয়েছে। আরও অনেককে ঘরছাড়া হতে হয়েছে। দখলদারদের সহিংসতাও রয়েছে। সে হিসাব করতে গেলে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেশ দেরিতেই দেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় ফিলিস্তিনিরা অবাক হয়নি। ইসরায়েলিরাও অবাক হয়েছে তা বলা যাবে না। ইসরায়েল সরকারের বিবৃতি ইসরায়েলের নাগরিকরা নিয়মিত দেখেন। প্রতিটি বিবৃতিই হিব্রু ভাষায় থাকেৎ, তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না। আমরা ভালোমতোই জানি, জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা এই হত্যা উপভোগ করেন। অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে তারা আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। এরই মধ্যে নির্লজ্জভাবে একজন ঘোষণা করেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে ফিলিস্তিন অর্ধেক খালি করে ইহুদিদের জন্য আবাসস্থল গড়া হবে। নেসেটের একজন সদস্য হিসেবে ইসরায়েলের সংসদে বিষয়টির তীব্র প্রতিবাদ করি। আমাকে তারা উপযুক্ত শাস্তিও দিয়েছে। আপাতত সংসদে ছয় মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা চলছে। আমার দোষ, আমি সরকার ‘গণহত্যা’ করছেÑ এই শব্দটি ব্যবহার করেছি। এথিক কমিটি জানিয়েছে, ‘গণহত্যা’ শব্দ অন্তত গাজায় চলমান যুদ্ধাবস্থাকে উপস্থিত করার প্রধান শব্দ হতে পারে না।
ইসরায়েলি পার্লামেন্ট যেন বাস্তব দুনিয়া থেকে আলাদা। তারা অপরাধকে উদযাপন করে এবং অপরাধীদের হিরো বানায়। যারা ন্যায়ের জন্য লড়াই করেন তাদের বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেন। আমাকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে সেটা যে নোংরা রাজনীতিরই অংশÑ তা আর বলে দিতে হবে না। নেতানিয়াহুর রক্তাক্ত হাতের ভার একটি গোটা রাষ্ট্র বহন করছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় শুধু আমিই পর্যুদস্ত হইনি। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ইহুদি ও আরব নাগরিকও রয়েছেন। তারা নিজেরা নেতানিয়াহুর গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণার সমর্থক নন। বরং তাদের অনেকেরই মত, ইসরায়েলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিলোপ পেয়ে একধরনের ফ্যাসিবাদী চরিত্র দেখা দিতে শুরু করেছে। যে রাষ্ট্রে একটি রাজনৈতিক পক্ষ সব সময় অন্য একটি রাজনৈতিক পক্ষ থেকে আভিজাত্যের পরিমাপে বড়; সে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আছে বলা যায় না। ইসরায়েল বরাবরই তাদের ফিলিস্তিনি নাগরিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের প্রতিটি অংশেই তাদের হস্তক্ষেপ।
নিজের পূর্বসূরিদের তুলনায় হিংস্রতায় নেতানিয়াহু অনেক এগিয়ে। তারা গণতন্ত্রের ধারক এমন একটি ভ্রম ধারণায় রয়েছে। বরং নেতানিয়াহুর সরকারে ইসরায়েলের সবচেয়ে জঘন্য অভিজাত সমাজের বাস। অনেকেই দখলদার এবং অধিকাংশই অপরাধপ্রবণ। ইসরায়েল সরকার প্রকাশ্যেই যতদূর যায় নিজের দখল কায়েমের ঘোষণা দেয়। অন্তত জোট সরকার গঠনের সময় এমন আশ্বাসই দেওয়া হয়েছিল। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার সময় আমি ও আমার সহকর্মীরাও কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানাই। হামাসের এই হামলাকে কোনোভাবেই যৌক্তিক বলা যাবে না, তেমনি গাজায় এভাবে নির্বিচারে দীর্ঘদিন হত্যাযজ্ঞ চালানোকেও সমর্থন করা চলে না। ইসরায়েল সরকার মধ্যপ্রাচ্যে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তারা তাদের বর্ণবাদী আচরণ নিয়ে মোটেও লজ্জিত নয়। গণতন্ত্রের ভেকধারী হয়ে তারা অসংখ্য অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের রাজনীতিতে আরবদের প্রবেশাধিকার নেই। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে হাসপাতালকর্মী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এমনকি সাংবাদিকদের প্রাণও রেহাই পাচ্ছে না।
গাজায় কিছু অতিউৎসাহী দখলদারকে সবুজসংকেত আগেই দেওয়া আছে। তারা চাইলে যেকোনো ফিলিস্তিনির বাড়ি দখল করতে পারে। সীমান্তে কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেদিকে কর্ণপাতও করেন না। ফিলিস্তিনিদের থাকার জায়গা আরও সংকুচিত হচ্ছে। তাদের ওপর ভারী কামান দাগা হচ্ছে। বিগত কয়েক দশকে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েলের সীমানা বাড়ানোর মহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এজন্য তিনি আরব ও ইহুদিদের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতেও রাজি। তার সরকার জিম্মিদের ত্যাগ করেছে এবং যুদ্ধবিরতি কিংবা শান্তির পথ পরিত্যাগ করাতেও কোনো ভুল দেখছে না। আমাদের অবশ্য হাল ছাড়লে চলবে না। বরং শান্তি অর্জনের জন্য আমাদের সবকিছু করার সামর্থ্যে আস্থা রাখতে হবে। যখনই স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার আমাদের সামনে থাকবে, তখন জিঘাংসা আর থাকবে না। বরং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ উন্মুক্ত হবে।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। আজকের বাস্তবতা তমসাচ্ছন্ন মানে এই নয় যে, আগামীর সূর্যোদয় হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিস্ময়বোধ ভাঙতে হবে। বরং আমাদের এই সময়ে ইসরায়েলের মানুষের সমর্থনে কাজ করতে হবে। আমাদের সরকার যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়, তাহলে তারাও কিছুটা আটকাতে বাধ্য হবে। যদি উভয় পক্ষের জন্যই শান্তি চেয়ে থাকেন, তাহলে শান্তি ও মুক্তির জন্যই আকাঙ্ক্ষা রাখুন। যুদ্ধ কিংবা ধ্বংস কাম্য নয়।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন