পর্যবেক্ষণ
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:১৬ পিএম
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে নজিরবিহীন ঘটনা ও জেলা আদালতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। ২৮ নভেম্বর তার এ উদ্বেগের কথা জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। ২৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যে অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে তা শুধু ন্যক্কারজনকই নয়, একই সঙ্গে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পারদও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে সঙ্গত কারণেই। আদালত বিশেষ করে উচ্চ আদালত মানুষের শেষ ভরসা এবং আশ্রয়স্থল। কিন্তু এ আদালতেই যখন এমন ঘটনা ঘটে এবং কোনো কোনো আইনজীবীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি দৃশ্যমান হয় তখন শুধু আশাহতই নয়, সচেতন যেকোনো মানুষকে প্রশ্নমুখরও করে তোলে।
জুলাই-আগস্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপটে শান্তিপ্রিয়রা সঙ্গতই প্রত্যাশা করেছিলেন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় কল্যাণ কিংবা শুভর আলো ছড়াবে। আমাদের অজানা নয়, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কীভাবে শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং একটি স্বেচ্ছাচারী সরকারের পতন ঘটে। এ প্রেক্ষাপটেই গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। আমরা সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি, দেশের অনেকেই তখন বলেছেন স্বৈরাচারের বৃত্ত থেকে দেশটা বেরিয়ে এলো। তারা আরও বলেছেন, এবার সুশাসনের আলো ছড়াবে, অধিকারের পথ সুগম হবে এবং মানুষ মুক্তকণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারবে। কিন্তু এখন সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জননিরাপত্তা, মব জাস্টিস, বাজারের তাপ-চাপসহ নানা বিষয়ে কথা হচ্ছে। অনেকেই ইতোমধ্যে এ প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন, দেশ চলেছে কোন পথে? আমরা আশা রাখতে চাই, দেশ সুপথেই চলবে এবং বিশেষ প্রেক্ষাপটে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরা ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি রেখে গণমানুষের কল্যাণে আগামীর দিনগুলো নিষ্কণ্টক করতে সক্ষম হবেন।
স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে স্বাধীনতার ৫৩ বছরের রক্তস্নাত বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের সড়ক নির্মাণ করলেও এক একটা আন্দোলন-সংগ্রাম পরবর্তী অর্জনের পর এর বিসর্জন ঘটে গেছে রাজনীতিকদেরই ভুলে কিংবা হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের কারণে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেই রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রস্তাব আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে জনপ্রত্যাশা মোতাবেক ইতোমধ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে এবং এ কমিশনগুলোর কার্যক্রম চলমান। অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকারের এ কার্যক্রম শান্তিপ্রিয়দের মনে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি হতাশা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অনেক দিকও আছে। আমরা দেখছি, জনজীবনের নানা সমস্যা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের মুখে পড়েছে জননিরাপত্তা ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী পারদের বিষয়টি। এর পাশাপাশি রয়েছে সমাজের নানা স্তরে এমন কি আদালত প্রাঙ্গনেও বিশৃঙ্খলার চিত্র।
একজন বিচারক শুধু ব্যবস্থারই স্মারক নন, সাধারণ মানুষের আস্থারও প্রতীক বটে। অতীতে কোনো কোনো বিচারকের কর্মকাণ্ড কিংবা কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি তা নয়, কিন্তু সে সবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। আমরা পেছনে তাকালে দেখতে পাই, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের টানা ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনকালে কিংবা তারও আগে অন্য রাজনৈতিক দলের শাসনকালে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপের অনেক নজির। তার পরও আমরা লক্ষ করেছি, বিরুদ্ধমত দমনপীড়নে ভিন্নমতাবলম্বীদের আটকে রাখা যায়নি এবং এর পেছনে অন্যতম কারণ উচ্চ আদালতের ন্যায়বিচার ও বলিষ্ঠ ভূমিকা। একজন বিচারক আদালতে যদি ভিন্ন বক্তব্য দেন এর প্রতিবাদ জানানো বিভিন্ন পথ উন্মুক্ত রয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো বটেই কোনো আইনজীবীরও এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অসদাচরণ করার কিংবা সহিংস হয়ে ওঠার কোনো অবকাশ নেই। বিচারকের প্রতি ডিম ছুড়ে যিনি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি আইনজীবী হিসেবে তার শপথ ভঙ্গ করার পাশাপাশি বিচারালয়ে কুনজির স্থাপন করেছেন। প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে দেশের আদালতগুলোয় এরূপ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। শান্তিপ্রিয় ও সচেতন মানুষের প্রত্যাশা, আদালত প্রাঙ্গণ যাতে কোনোভাবেই কারও বৈরী আচরণে কলুষিত না হয় তা নিশ্চিত করা হবে। মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, আাদালত কোনো রাজনৈতিক ময়দান নয়। আইনি পন্থায় সংক্ষুব্ধ আইনজীবী প্রতিকার না চেয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে যে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন এর যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
৫ আগস্ট-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ‘মব জাস্টিস’ শব্দযুগল সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন খবরের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। আমরা দেখেছি, বিগত তিন মাসের বেশি সময়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কারণে সমাজে অনেক মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছে। বিচার বিভাগের ওপরও কিছু অঘটনের ছায়া পড়েছে। শিক্ষার্থীরা দুবার দাবি আদায়ের জন্য সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ঘেরাও করে রাখেন। এ দৃষ্টান্তগুলো কোনোভাবেই স্বস্তি কিংবা প্রীতিকর নয়। একজন আইনজীবীর বিচারকের সঙ্গে আচরণের রূপ কেমন হবে তা তার অজানা থাকার কথা নয়। আমরা জানি না, সংক্ষুব্ধ ওই আইনজীবী কোন মতাদর্শ লালন করে আইন পেশার মতো একটি মহৎ পেশায় যুক্ত আছেন। নিম্ন আদালত তো বটেই, দেশের উচ্চ আদালতে বিচারকের অসম্মানিত হওয়া কিংবা বৈরী আচরণের শিকার হওয়ার ঘটনা যখন ঘটে তখন মানুষের আস্থার স্তম্ভ কিংবা ভরসার জায়গা বলে আর কিছু থাকে না। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে ন্যায়বিচার ও সুশাসনের দাবি নতুন নয়। আমরা কখনও কখনও এ ব্যাপারে আইনজীবীদেরই অধিক উচ্চকণ্ঠ হতেই দেখেছি। যে আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছেন তিনি আইনজীবী সমাজের সদস্য হয়ে থাকার অধিকার আর রাখেন কি নাÑ এ প্রশ্নটি উড়িয়ে দেওয়ার নয়।
সম্প্রতি গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে ‘মব জাস্টিস’ কঠোর হাতে দমনে সরকারের প্রতি সম্পাদক পরিষদ আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। সম্পাদকরা বলেছেন, ‘মব জাস্টিস’ কঠোর হাতে দমন করতে হবে। আমরা চাই, আর যেন প্রশ্ন না ওঠেÑ সুবিচার কোন পথে? সমাজের সচেতন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা যদি উচ্ছৃঙ্খল আচরণ দৃশ্যমান করেন তাহলে তো অবক্ষয়িত এ সমাজের বিপথগামীরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এমনিতেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে ইতোমধ্যে বিস্তর প্রশ্ন উঠেছে। সরকারকে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি দৃশ্যমান করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকেও ন্যায্যতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবেÑ আইনের কাছেই মানুষ নিরাপদ। যে আইনজীবী আদালতে দাঁড়িয়ে বাদী কিংবা বিবাদীর অধিকার সুরক্ষায় ভূমিকা রাখেন তিনি নিজেই যদি বৈরী আচরণের হোতা হন, তাহলে এ প্রশ্নটি আরও কঠিনভাবে সামনে আসেÑ দেশ চলেছে কোন পথে?
সাংবাদিক ও কবি