স্মরণ
ইমরান ইমন
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:১২ পিএম
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক।
১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর, মতান্তরে ১৯১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জন্ম। দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক সক্রেটিসের মতো জ্ঞানার্জনে জীবন অতিবাহিত করেছেন। কিংবদন্তিতুল্য জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত সিং। জ্ঞানের সমুদ্রে ডুবে ছিলেন চিরকাল। যার কাছে জগৎ-সংসার ছিল গৌণ, জ্ঞানার্জনটাই ছিল মুখ্য। তিনি ছিলেন শিক্ষকদেরও শিক্ষক।
১৯৩১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন আবদুর রাজ্জাক। ১৯৩৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে এ বিভাগ থেকে অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান দুটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে বিখ্যাত অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে পিএইচডি করার জন্য লন্ডন গমন করেন; তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহ। ১৯৫০ সালে আবদুর রাজ্জাক গবেষণা সন্দর্ভ জমা দেওয়ার আগেই প্রফেসর লাস্কির মৃত্যু হয়। লাস্কির মতো শিক্ষকের মৃত্যুতে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রচণ্ড মর্মাহত হন এবং গবেষণাকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ১৯৫৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়।
তাকে অনেকে বলে থাকেন স্বাধীন বাংলাদেশের তাত্ত্বিক রূপকার। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য তিনিই প্রথম সবার নজরে আনেন এবং এ থেকেই দুই অর্থনীতি তত্ত্ব, ছয় দফা ইত্যাদির জন্ম হয়। অধ্যাপক রাজ্জাকের পাণ্ডিত্যের জন্য দেশবিদেশের নানা গুণীজন তার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ডিক উইলসন তাকে বই উৎসর্গ করেছিলেন, খুশবন্ত সিং তাকে নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছিলেন এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দিয়েছিল সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি।
১৯৭৩ সালে ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পিএইচডি প্রদান করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করে। তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত ছিল বিশেষত প্রাচ্যতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতিতে।
প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক বেশিরভাগ মানুষের কাছেই দুর্ভেদ্য এবং রহস্যময়, কেননা জীবদ্দশায় যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করেছেন, তার সিকিভাগও তিনি লিখে রেখে যাননি, যার জন্য তার দর্শন, মতবাদ, চিন্তাচেতনা কিংবা পাণ্ডিত্যের রেশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কেবল তার শিক্ষকতা এবং শিক্ষকতা-পরবর্তী সময়ে যারা তার সান্নিধ্য লাভ করেছেন তারাই জানেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক কতটা মহান ব্যক্তি এবং জ্ঞানী, দার্শনিক ছিলেন।
পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও তার বাঙালিয়ানা প্রকাশ পেত। কেননা খদ্দরের পাঞ্জাবি-পাজামা আর মাঝে মাঝে কাঁধে একটি চাদর কিংবা লুঙ্গি আর কুর্তাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। বই পড়া এবং সংগ্রহ করা বাদে তার আরও দুটি নেশা ছিল। তা হচ্ছে বাজার করা এবং রান্না করা।
তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি যেকোনো দেশে গেলেই দুটি জিনিস দেখি। এক কাঁচাবাজার, অন্যটা হলো বইয়ের দোকান। আমার মনে হয় কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক। যে দেশে বইয়ের দোকান নেই সে দেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না। কাঁচাবাজার দেখলেই বোঝা যায়, দেশের অবস্থা কেমন। বইয়ের দোকানে গিয়ে কী ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি হয় তা দেখেই দেশের জ্ঞানচর্চার অবস্থা বোঝা যায়।’
সত্যিকার শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, ছাত্রদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবেন। চেয়ে থাকেন তার ছাত্রটি কবে মানুষের মতো মানুষ হবে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ছিলেন তেমনই একজন। সততা, শুদ্ধতা আর জ্ঞানার্জনের তৃষ্ণায় কাতর যে জীবন আবদুর রাজ্জাক যাপন করেছেন, তা প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জীবনী আমাদের জন্য নিরন্তর প্রেরণার উৎস। জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।